Translate

শুক্রবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৭

হনুমান

           


         দূর থেকে রেলইঞ্জিনের শব্দ শুনে শুনে আঙুলের কর গুনে পিতা পুত্রের বয়সের অঙ্ক কষছে পিন্টু। তিলক স্যার খাতায় অঙ্ক কষে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন কিন্তু তখনও কিছু মাথায় ঢোকেনি এখনও সেই অঙ্ক মাথায় ঢোকাবার বিফল প্রচেষ্টা করে চলেছে সে। মান্তু একবার উঁকি মেরে  মুচকি হেসে চলে গেল। এই 'পিতা পুত্র', 'গরু-মোষ', 'চৌবাচ্চায় জল ভর্তি'র অঙ্ক  সে পার করে এসেছে। এখন পিন্টুর সে সব যন্ত্রণা ভোগের পালা।মান্তুু বাংলার নোটের খাতায় মুখ গুজে দুলে দুলে পড়তে লাগল মা বললেন... "কি রে মান্তু দুধটা দিয়ে গেলাম খাসনি। "সন্ধ্যার সময় রেল কোয়ার্টারের পাড়ার রাস্তা ঘাটে লোক জন কমই বের হয়। সবে সবে শীতের আগমণ হয়েছে।  দিনের  আলো  মিলিয়ে যায় দ্রুত  সঙ্গে সঙ্গে নিমন্ত্রণ আসে আঁধারের। সারা দিনের কর্ম ব্যস্ততার পর খানিক আলস্যতা আসে শরীরে। পাখির ঝাঁক ঠিক সময়ে ফিরে যায় নিজের বাসায়। সারাদিনের কোলাহলের মুখে আঙুল রেখে স্বল্প নিস্তব্ধতার মধ্যে চুপিসারে সাঁঝ বলে সায় অনেক কথা কিছু উদাসতা আবার কিছু সংকেত, দিন ফুরিয়ে যাওয়া সংকেত। হঠাৎ ঘরের ছাদে ধুপ ধাপ শব্দ শোনা গেল। ঝড় নয় শিলা বৃষ্টি নয় হঠাৎ এমন শব্দ। চারিদিকের পরিবেশও চুপ চাপ শুধু আসে পাশের বাড়ি থেকে টি.ভির নিউজ চ্যানেলের শিরোনাম শোনা যায় পাশের বাড়ির দাস জ্যাঠিমা কেবল সিরিয়াল দেখেন তাও হাই ভল্যুউমে সব মিলিয়ে বাতাবরণে একটা মিশ্র শব্দ ছড়িয়ে তারই মধ্যে রেল কোয়ার্টারের অ্যসবেস্টস ছাদের উপর শোনা গেল ধুপ ধাপ। পিন্টু অঙ্কের খাতা ফেলে ছুট্টে এসে মায়ের পেটের কাছটা জড়িয়ে ধরল। মা বলল ..."দাঁড়া ভয় করলে হয়।সামনের দরজাটা বন্ধ আছে তো। "দরজাটা বন্ধ দেখে বারান্দায় গিয়ে গ্রিলের ভেতর দিয়ে দেখে পেল্লাই পেল্লাই খান চারেক হনুমান তাদের কোয়াটারের বাগানে লম্ফঝম্প করে চলেছে। হনুমান দেখে পিন্টুর মন থেকে 'চোর ডাকাত' কিংবা ভুতের ভয় দূর হয়। সাহস তার সমহিমায় বেরিয়ে আসে। ও হনুমানকে আঙুল দেখিয়ে বলতে থাকে ..."এই হনুমান কলা খাবি। "
              সেই দিনের পর থেকে হনুমানের দল বারকয়েক আক্রমণ করেছে। দুপুর বেলা রবিবারের ছুটির দিনে সবাই এক সঙ্গে খেতে বসেছে। মটুসুটু পিন্টু আবার মুরগীর মাংসের ভক্ত। মা তা ভালোভাবেই জানেন মান্তু আবার মাছের। শীতের দুপুরে চারিদিকে নরম রোদের আস্তরণ। সবুজ গাছ পালা গুলো যেন সেই নরম রোদের স্নেহের ছোঁয়ায় আরও সতেজ হয়ে উঠেছে। অ্যাসবেস্টস ছাদে আবার সেই চেনা পরিচিত ধুপ ধাপ শব্দ। বাবার তাগড়াই চেহারা। লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ শরীরের পুরুষ মানুষ। এঁটো  হাত ধুয়ে সজোরে লুঙ্গিতে গাঁট দিয়ে "দাঁড়াত"বলে একটা লাঠি  নিয়ে বেরিয়ে এলেন। বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পাই পাই করে চারিদিকে লাঠি ঘোরাতে লাগলেন "আয় শালা তোরই একদিন কি আমারই। "বাগানের অবস্থা দেখে তারও মাথা গেছে ঘুরে। অনেক সাধ করে পেঁপে গাছ লাগিয়েছিলেন। বলেছিলেন ..."আমার হাতের ফলন ভালো হয়। ছেলে বেলায় অনেক গাছ করেছি। "সবে সেই গাছে ফুল এসেছে কয়েকটাতে তো কচি কচি পেঁপেও হয়েছে। বীর হনুমান রাবণের অশোক বাটিকা ধ্বংস করেছিলেন তা নয় ন্যায় সম্মত ও বীরত্ব প্রদর্শনের সাপেক্ষে যথেষ্ট অর্থ বহন করে কিন্তু এই হনুমানের দল কি কারনে তার সখের বাগান তছ নছ করে। হনুমান গুলো বাবার অমন মূর্তি দেখে লেজ তুলো দৌড়া দৌড়ি শুরু করে। এক জন ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সামনের পেয়ারা গাছের ডাল ধরে ঝুলে আবার এক লাফে পৌঁছে যায় দাস জ্যাঠিমার আতা গাছে আরেকজন  দু তিন লাফে পালায় পেছন পাড়ায় যোশীজির বাগানের জাম গাছের মগ ডালে ।বাকি গুলোর দল ভঙ্গ হওয়ায় এলোমেল ভাবে ছড়িয়ে  সামনের সুরকির রাস্তা ধরে পালায়। পাড়ার নেরি কুকুর গুলো উচ্চ স্বরে ঘেউ ঘেউ করে পিছু নেয়। বাবা তো বীরপুরুষের মতো হনুমানদের পরাজয় করে ঘরে ঢোকেন। পিন্টু বাবার কৃতিত্বে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে খাটের উপর উঠে লাফা লাফি করছে। মাও স্বামীর বাহাদুরীতে আপ্লুত হয়ে বলল ..."ভাগ্গিস্ তুমি বাড়ি ছিলে, রোজ ব্যাটারা আসে এই ভয় পেল আর আসবে না। "
         মান্তু সাইকেল করে টিউশুনি থেকে ফিরল। পিন্টু দিদির সাইকেল চালাবার বায়না ধরেছে..."দে না দিদি একটু চালাই।"মান্তুর শখের সাইকেল কোনও মতেই পিন্টুর হেফাজতে দেওয়া চলে না। সে বলল ..."ঠিকাছে তুই পেছনে বস আমি এক পাক ঘুরিয়ে আনব। "অগত্যা নিরুপায় পিন্টু রাজি হয়ে যায়। আজ আবার পারোমিতার সঙ্গে মান্তুর বাংলা নোট নিয়ে মন কষা কষি হয়েছে। জ্বরের জন্য মান্তুর দিন কয়েক টিউশুনি কামাই হয় তাই পারোমিতার কাছে নোটের খাতা চেয়েছিল কিন্তু সে কিছুতেই দেয়নি। 'বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের' নোট ছিল। মান্তুর মাথায় এখন 'বাংলার নোট' ঘুরছে।এক নোট বিনা সংসার পিছিয়ে পড়ে আরেক নোট বিনা বিদ্যালয়ের পড়া।পিন্টু সক্কাল সক্কাল  এক বাটি মুরী নিয়ে বসেছে জানলার ধারে হঠাৎ এক হনুমান পিন্টুর হাত খপাত করে ধরে তারপর বাটি নিয়ে দৌড়। পিন্টু তো ভ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করে। মান্তু বাবার বীরত্ব অনুসরণ করে লাঠি হাতে তাড়া করে। হনুমানও কি কম চালাক। পুরুষ মানুষ  অার বালিকার তফাত সে ভালোভাবেই জানে। পেঁপে গাছের পাতা গুলো মুড়িয়ে মুড়িয়ে  রোল করে এগরোল খাওয়া ভঙ্গিমায় তারা খেতে ব্যাস্ত। লাঠি হাতে মান্তুকে দেখে গাছ থেকে ঝুঁকে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করল। মান্তু ভয় লাঠি ফেলে "...ওরে বাবা  গো..."বলে ছুট্টে সোজা ঘরে। হনুমান এলাকার সবার বাড়িতেই নানা রকম উপদ্রব শুরু করেছে।ঘেটু কাকুর বৌ উঠনে ডালের বরি দিয়েছিল তাও খেয়ে ছড়িয়ে নষ্ট করেছে। এমন পরিস্থিতিতে এড়েদা থেকে এল পিন্টুর মামা। পুরুলিয়ার নিকট রেলের শহর জল হাওয়া ভালো তাই কিছু দিন দিদির বাড়ি থেকে হাওয়া বদল করতে অাসা। ছুটির দিনে দুপুরবেলায় খাওয়া সেরে মান্তু আর পিন্টু মামাকে ধরে গল্প শোনাও ..."দাঁড়া বাপু আমি গল্প টল্প শোনাতে পারব না। "পিন্টুও জেদ ধরেছে তবে ক্যারাম খেল। পাশেব় বাড়ির সুমনাদি আবার হাজির হল এক বাটি পায়েস নিয়ে। গোলগাল টুকটুকে ফর্সা গায়ের রঙের সুমনা মামার দিকে তল চোখে চেয়ে মা কে মৃদু হেসে বলল..."মা পায়েস পাঠিয়েছে। "যুবতীকে দেখে মামার হৃদয়ের ধ্বনি খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে ধনিত হতে লাগল। মামাও যুবক মনে মনে ভাবছে এই পায়েসের মাধ্যমে হয়ত যুবতী তার সঙ্গে বন্ধুত্বের একটা মধুর সম্পর্কের সূচনা করতে চাইছে। পিন্টু সুমনার হাত ধরে টেনে বলল ..."সুমনাদি চল না খেলি, ক্যারাম খেলা। "মামা তো খানিকক্ষণ আগে এই সব খেলাধুলায় বিন্দু মাত্র রুচি দেখাচ্ছিল না কিন্তু এই আগন্তুক যুবতী  তার সকল বিষয়ে রুচি বাড়িয়ে তুলেছে। মামা তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে ক্যারাম বোর্ড সাজিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। মামার পরনে একটা লাল গেঞ্জি  আর হাঁটু অবধি শর্টস। তরুণীর নজর বার বার মামার উন্মুক্ত ঠ্যাং এর দিকে যাচ্ছে আর সে মুচকে হেসে মান্তুর দিকে তাকাচ্ছে। মামা মাটিতে শতরঞ্চির উপর পা মুড়ে বসেছে বাঁ পায়ের পাতাটা ক্রমান্বয়ে নাড়িয়ে চলেছে। ক্যারামের একটা শট খেলে সুমনাকে জিজ্ঞাসা করল ..."তুমি কি পড়ছ ? "
..."এই বছর বিএ ফাইনাল ইয়ার, তুমি কি পড়? "
..."আমি লাস্ট ইয়ার পাস করেছি এখন ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢুকব।"সুমনা মান্তুকে বলল..."কাল সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যাবি। "মান্তু আনন্দে লাফিয়ে উঠল বলল ..."কি বই গো সুমনাদি। "
..."অ্যকশন মুভি আমার ভীষণ ভালো লাগে অ্যকশন হিরো আমার ফেভারিট। "পিন্টুও দু হাত তুলে নাচতে নাচতে বলল..."আমিও যাব। "মামা ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হাসি এনে বলল ..."সিনেমার অ্যকশন তো আসল অ্যকশন নয় ওগুলো সব অ্যানিমেটেড কম্পিউটার গ্রাফিক্স আমার তো রিয়েল অ্যাকশন ভালো লাগে। "সুমনা একটু রেগে গিয়ে বলল..."ওমা রিয়েল অ্যাকশন কোথায় পাব। "মামা পা দুটো সামনে সোজা করে মেলে আরমোড়া ভেঙে সুমনাদির দিকে জল জল দৃষ্টিতে তাকিয়ে  বলল..."কলেজে একটা ছেলেকে যা মার মেরেছিলাম না সে আজও ভোলেনি। "সুমনা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল ..."তা তো আমরা দেখিনি।"মামা সুমনাকে আরও ইমপ্রেস করার জন্য বলল..."আমি তো ক্যারাটে শিখেছি। "এমন সময় আবার ধুপ ধাপ শব্দ।পিন্টু চেঁচাল ..."আবার হনুমান..."সুমনা বলল ..."যান আপনার ক্যারাটে পরীক্ষার সময় এসে গেছে। "..."অনেক দিন ধরে তোরা বলছিস না হনুমান তিষ্টতে দিচ্ছে না। দাঁড়া আজ এমন বুদ্ধি করব হনুমান আর আসবে না। "মান্তু বলল ..."কি মামা? "
..."শুধু অ্যাকশন মুভি দেখলে হবে বুদ্ধিরও অ্যপলাই চাই। "বলে মামা ছুটে গিয়ে ড্রয়ার থেকে ছোট আয়না বের করে এনেছে। সুমনা বলল ..."এতে কি হবে? "
"আজ হনুমানের সামনে আয়না ধরব বলব দ্যাখ তোকে কেমন দেখতে। "মামা সুমনার প্রতি তার বুদ্ধি মত্তা আর বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য হাতে আয়না নিয়ে ছুটল বাগান। মামার পিছু নিল পিন্টু, মান্তু আর সুমনা। একটা বিশালায় হনুমান পেয়ারা গাছে বসে পেয়ারা খাচ্ছিল মামা আয়নাটা হনুমানের সামনে ধরল। হনুমান দাঁত মুখ খিঁচিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে মামার হাত থেকে আয়না নিয়ে এক চড় কষাল। মামাও সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারাল।
                   খাটের মাথার কাছে মান্তু পিন্টু মামার হাতের পাতাটা নিজের হাতে ধরে রেখেছে। সুমনাদি মুখের কাছে ঝুঁকে চেয়ে আছে। মামার জ্ঞান ফিরলেও ধুম জ্বর। মা ডাক্তার ডেকে এনেছেন। পরের দিন সুমনাদি বাড়ি এসে বলল ..."অ্যাকশন, ক্যারাটে তো অনেক হল এবার লক্ষ্মী ছেলে হয়ে দিদির আদর খাও। "মামার আর বীরত্ব প্রকাশের কোনও জায়গা নেই। হনুমানের চড়ে ও শুধু জ্ঞান হারায়নি ওর জ্বরও চলে এসেছে। বাবা দুপুরে অফিসের মাঝে দু প্যাকেট মুসাম্বি নিয়ে ঢুকলেন। হনুমানকে শায়েস্তা করতে আহত শালকের শুশ্রূষা দরকার সঙ্গে  একটা সংবাদ আনলেন। সকলকে সমবেত করে বললেন..."শোনও ঐ হনুমানের দলের একজন লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে গাছের ডালের মতো ইলেকট্রিক তারে ঝুলতে গিয়ে মারা পড়েছে।"শোনামাত্র মামা "অ্যাঁ"বলে উঠে বসল।
..."স্টেশনের সব কুলিরা তাকে সমাধিস্থ করেছে বলছে ওর সমাধির উপর বজরঙ্গবলীর মন্দির হবে। "মা ভক্তি ভরে প্রণাম করে বললেন..."হনুমান তো বজরঙ্গবলীর রূপ এচত্বরে একটাও বজরঙ্গবলীর মন্দির নেই। ভালো হল আমি শনি মঙ্গল বার যাব। "পিন্টু বলে উঠল ..."ভালো হয়েছে বদমাইসটা।"মা পিন্টুর মুখে হাত দিয়ে বললেন ..."না বাবা বলতে নেই ঠাকুর রাগ করবেন। উনি সঙ্কট মোচন হনুমান সব সঙ্কট দুর করবেন। "শত অত্যাচারের পর হনুমানের দল একটা মন্দির উপহার দিয়ে গেল। অশান্তি কাটিয়ে এলাকায় শান্তির হাওয়া ছড়িয়ে পড়ল। 

ব্লগে ব্যবহৃত ছবির সৌজন্যঃ-গুগল







বুধবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৭

নিয়তি

     
        বাজার পেরিয়েই বংশিদের মুদি দোকান। মস্ত বড় দোকান।দোকানে ঢুকতেই ডান পাশে ছিম ছাম চেহারার কমলা সাধু হাতে পেন আর কাগজ নিয়ে খদ্দেরের ফর্দ লিখতে সর্বক্ষণ ব্যস্ত অবস্থায় থাকে। দোকানে ভিড়ও ব্যাপক সব জিনিসের কোয়ালিটি এক নম্বর আবার জিনিস পিছু দামেও ছাড় মেলে। বড় ভাই রসিক সাধুর বয়স হয়েছে সে এক কালে দাপিয়ে দোকানদারি করেছে এখন ক্যাশের দায়িত্বটা নিজের কাছে রেখেছে। দোকানের সামনে বড় বড় চালের বস্তার খোলা মুখে কোয়ালিটি অনুযায়ী দামের লেবেল করা চৌক পিজবোর্ড রাখা। খদ্দেররা অনেকে হাতে চাল তুলে চালের আকার আকৃতি দেখছে অনেকে দাম দেখে আবার হাত ঝেড়ে চাল বস্তায় ফেলে চলে যাচ্ছে। খানিকটা ভিতরে ঢুকতে বস্তায় বস্তায় সারি সারি নানান রকম ডাল টিনের জারে তেল ঘি রাখা ।কর্মচারী ইলেকট্রিক ওজন যন্ত্রে ওজন করে সব জিনিস দিচ্ছে। দোকানের দেওয়ালে শোকেজে প্যাকেটের সব জিনিস ঠাসা। স্বল্প মূল্যের পাউচ প্যাকেট গুলো ঝোলানো রয়েছে। অনেক দিনের দোকান ।বংশী সাধুর বাপের আমলের বংশিও বেঁচে নেই কিন্তু তার নামেই দোকান চলছে। চারজন কর্মচারী আছে তাতেও মাসের প্রথমে মাসকাবারি করতে আসা খদ্দেররা যখন এক সঙ্গে এসে হামলে পড়ে তখন সামাল দিতে গলদঘর্ম হতে হয় সকলকে। কমলা সাধুর একমাত্র ছেলে রমেশ। রসিক সাধুর দুই মেয়ে তাদের বিয়ে হয়েগেছে অনেক বছর। এই দোকানের দায়িত্ব ভবিষ্যতে যার হাতে আসবে সে হল এই রমেশ। কিন্তু বাপ ঠাকুরদা  যে মেহনত করে এই দোকান দাঁড় করিয়েছে তার প্রতি কোনও মোহ মায়া নেই তার। সে তো প্রেমিক স্বভাবের। একান্নবর্তী পরিবারের এক মাত্র ছেলে যখন যা বায়না করে বাপ জ্যাঠা  তা দিয়ে দেয়। কষ্ট করে উপার্জনের সুখ মর্ম সে কিছুই জানেনা সে তো প্রেমিক তার প্রেমের স্বপ্নে উড়তে ভাল লাগে। গেল বছর জন্মদিনে বাপের কাছ থেকে  একটা বাইক আদায় করেছে। রসিক সাধু সেকেলের  মানসিকতার লোক ধমকে কমলাকে বলেছিল " যা মন চায় তাই কর এইভাবে ছেলের  মোহে ফুঁ দিয়ে টাকা ওড়ালে এক সময় কাঙাল হতে হবে। "সেই অতি শখের বাইকে চেপে দোকানে এসে উপস্থিত হল রমেশ। ইদানীং জ্যাঠা তার রকম সকমে বেশ অসন্তুষ্ট। রমেশ জ্যাঠা কে এড়িয়ে বাপের কাছে এসে ফিসফাস করছে। কমলা তার দাদা কে বলল ..."দাদা ওকে কিছু টাকা দাও না।"
..."কেন। ফুর্তি করতে এক পয়সা দেব না। "
..."জ্যাঠু কলেজ ফী। " এই বলে ক্যাশ বাক্সের উপর ঝুঁকে পড়ল রমেশ। দোকান ভর্তি লোক আর কর্মচারীদের সামনে কিছু বলতে না পেরে একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করল রসিক তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে আরেকটা জ্যাঠু বলে দুটো পাঁচশ নিয়ে বাইকে চড়ে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।
             রবিবার মাছের বাজারে নানা রকম মাছ ওঠে আজ আবার রসিকের মেয়ে জামাই আসবে। বাজারের থলি নিয়ে মাছের বাজারে ঢুকল। স্বভাবগত ভাবে হিসেবি রমেশ পাবদা, পার্শে, চিংড়ি যাই দর করে দাম শুনে পিছিয়ে চলে আসে। বাজার এখন কমলা আর রমেশ করে সে আসেনা বহুদিন তাই দাম গুলো যে এত বেড়ে গেছে তা হজম হয় না রসিকের। বড় ট্রে তে জলের মধ্যে চারা মাছ গুলো খাবি খাচ্ছে দামেও পোশায় কিন্তু মেয়ে জামাই আসছে। জামাই এর পাতে চারা মাছ দেয় কি করে। অনেক  দ্বিধায় মাংসের দোকানে লাইনে দিয়ে মুরগী কিনে বাড়ি ফেরে রসিক। কালবৈশাখীর সময় রোজ বিকেল হতেই মেঘে আকাশ কালো হয়ে আসে। চারিদিকে ধুলো উড়িয়ে ঝড় ওঠে। রমেশের বিকেলে ঋতুপর্নার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার প্ল্যান আছে। সেই স্কুলের  সময় থেকে নানা মেয়েদের সঙ্গে  প্রেম করে শেষমেষ এই ঋতুপর্না কে তার প্রেয়সী করে তুলতে চায় সে। মোবাইলে হোয়াটস  অ্যাপে মেসেজ এল..."কখন আসছ।"এপাশ থেকে রমেশ লিখল
..."পাঁচটায় বেরব। "সঙ্গে  সঙ্গে মোবাইল বেজে উঠল রমেশ হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে মিষ্টি কণ্ঠস্বরে ভেসে আসে ..."আগের বার পুরো দশ মিনিট দেরি করেছ এবার তার শাস্তি। "
..."শাস্তি ,এই শাস্তি কেন ওটা ট্রাফিকের জন্য দেরি হয়ে গিয়েছিল ।"
..."তা আমি জানি না তোমায় আগে থেকে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। "
..."জো হুকুম হুজুর। "বলে সশব্দে একটি চুম্বন রমেশ ফোনের এপাশ থেকে তার প্রেয়সীকে পাঠাল। 
          আলমারি খুলে ডেনিমের ব্লু জিন্স আর ঋতুপর্নার প্রিয় হলুদ রঙের টি শার্ট বের করল। বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ট্রিমার দিয়ে দাড়িটা ভলো করে ট্রিম করল তারপর হেয়ার জেল লাগিয়ে ব্যক ব্রাস করে চুল সেট করে নিজেকে নানা দিক থেকে ভালোভাবে দেখতে লাগল।ঋতুপর্না কেন? যখন ও বাইকে করে যাবে তখন যে কটা মেয়ে ফ্ল্যাট হবে সেটাই হল এখন চিন্তার বিষয়। বডি স্প্রে লাগাচ্ছে  এমন সময় রমেশের মা নাকে কাপড় দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল ..."কি সব ঝাঁ জালো গন্ধ গায়ে দিস বাবা এত গন্ধ আমার মাথা ধরে যায়। রোজই জামা কাপড় কাচছি তাতেও এসব দিতে লাগে। রমেশ কোনও গুরুত্ব না দিয়ে নিজের সাজেই মগ্ন।উনি বললেন ..."কোথায় যাচ্ছিস এখন? কি মেঘ করেছে খুব জোড় ঝড় আসবে।"
..."আমার দরকার আছে মা।"
..."কিসের দরকার এমন ঝড়ের মুখে আমি কিছুতেই  তোকে বেরতে দেব না। "
      রমেশ বিপদ দেখে কোনও রকম কথা বার্তায় না জড়িয়ে বাইকের চাবি নিয়ে তীরের বেগে বেরিয়ে গেল। বাড়ি থেকে বেরবার মুখে জ্যাঠার সামনে পরল রসিক চোখ মুখ কুঁচকে বলল..."এখন কোথায় বেরচ্ছিস ঝড়ের মুখে। "রমেশ জ্যাঠা কে এড়িয়ে বেরিয়ে  পড়ল। রসিক আপন মনে চেঁচাতে লাগল ..."এমন ঝড় বাদলের দিন, আমি বাইরে ফুল গাছের টব গুলো সব একধার করে রেখে এলাম,ওমা ঘরে ঢুকতে দেখি বাবু ফুলবাবু হয়ে চললেন ঝড়ের মধ্যে, যত সব। তোমরা বুঝবে আশকারা দিয়ে ছেলেকে মাথায় তুলেছ। "
       রাস্তার উপর বাইক ছুটছে চারিদিক ফাঁকা সামনে কালবৈশাখী তার কালো রূপের গর্বে ফুঁসছে। শুকনো হাওয়ার সঙ্গে রাস্তার ধুলো, শুকনোপাতা,প্লাসটিক আছড়়ে পড়ছে এদিক ওদিক। শুরু হল বৃষ্টি। রমেশ মেন রাস্তা ছেড়ে  গলিতে এসে উঠেছে। সামনে একটা বড় আম গাছের তলায় বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বার বার ঘরি দেখছে আজও সে লেট হয়ে যাবে। ঝতুপর্নাকে সামনের বকুল তলা স্টপেজ থেকে পিক করার কথা ছিল। কিন্তু এত বৃষ্টিতে ও কোথায় দাঁড়িয়েছে কে জানে। হঠাৎ শ্রবণ শক্তি বধির করে আকাশ চীড়ে তীব্র শব্দের সঙ্গে বাজ পড়ল।        দোকানে এক খদ্দের এসে বলছে ..."আগের বার যে চালটা দিলেন এবার সেই একই দামের চাল নিয়ে গেলাম কিন্তু অনেক তফাত। দাম এক কিন্তু পুরো ঠকেছি। "রসিক বলল ..."দাম এক হলে কোয়লিটি আলাদা হবে না। অনেক সময় ভাত সিদ্ধ করার সময়ের হেরফের হয় জল ঠিক থাকেন। "এই নিয়ে বচসা চলছে। এক খদ্দের এসে বলল ..."লিখুন দাদা মাল গুলো। "কমলা কাগজ পেন নিয়ে মুখে বলে বলে লিখতে শুরু করল..."মটর ডাল পাঁচশ,ময়দা এক কিলো, সাদা তেল পাঁচশ । "এক বয়স্ক মহিলা দোকানের বেঞ্চে বসে খানিক জিরিয়ে রসিককে জি জ্ঞাস করল ..."কি গো তোমাদের ছেলে কেমন আছে। " কমলার লিখতে লিখতে হাতটা থেমে গেল চোখ তুলে তাকাল। রসিক চশমা খুলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল ..."কি বলব দিদি অমন জলজ্যন্ত ছেলেটা পাষাণ হয়ে গেল। "
..."কি করবে বল সবই কপাল।এত বড় দোকান একটামাত্র ছেলে তার এমন অবস্থা। "
             সন্ধ্যার বাজারে হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে সবজি বাজারে এসেছে রসিক। বাল্বের আলোয় চটের উপর সবজি বিছিয়ে বসে আছে সবজি বিক্রেতা। শীতের সন্ধ্যা। চারিদিকের কুয়াশা ভেদ করে বাল্বের আলো এসে পড়ছে মাছ গুলোর উপর। সারি সারি মাছের রূপলী আস্তরণ পেরিয়ে  রসিক খানিকটা এগিয়ে গেল। বাজারে আজ প্রচুর ফুলকপি  উঠেছে। ব্যাগে বড় বড় তিনটে ফুলকপি কিনে টম্যাটো দর করছে এক জন পরিচিত ভদ্রলোক এগিয়ে এসে রসিকের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল ..."আরে রসিক কি খবর। "রসিক বলল ..."আরে দাস দা।"
..."তোমার ভাইপোর খবর শুনলাম। কি করে ঘটল এমন। "
রসিক খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল তারপর বলল ..."ঝড় বাদলের দিন ছিল একটা বড় আম গাছের তলায় বাইক নিয়ে দাঁড়িয়েছিল হঠাৎ জোরে একটা বাজ পড়ে অাম গাছের ডালে। ডালটা ভেঙে পড়ে রমেশের মাথায়। মাথায় চোট লেগে একেবারে ঘিলু বেড়িয়ে  আসে অনেক ঘন্টার অপারেশন করে কোনও মতে প্রাণে বাঁচে কিন্তু এখন পুরো পাষাণ। খাইয়ে দিলে খায় উঠিয় বসালে বসতে পারে। জোয়ান ছেলেটা বাচ্চা হয়ে গেছে। "বলতে বলতে রসিক আবার চশমা খুলে চোখের জল মুছতে লাগল। নিজেকে খানিক সামলে বলল ..."বড়দের কথা না শুনলে বড় মুশকিল সে দিন বার বার বেড়তে বারণ করেছিলাম শোনে নি। জলজ্যান্ত ছেলেটা পাষাণ হয়ে গেল।" 

ব্লগে ব্যবহৃত ছবির সৌজন্যে গুগল