Translate

শুক্রবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৭

হনুমান

           


         দূর থেকে রেলইঞ্জিনের শব্দ শুনে শুনে আঙুলের কর গুনে পিতা পুত্রের বয়সের অঙ্ক কষছে পিন্টু। তিলক স্যার খাতায় অঙ্ক কষে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন কিন্তু তখনও কিছু মাথায় ঢোকেনি এখনও সেই অঙ্ক মাথায় ঢোকাবার বিফল প্রচেষ্টা করে চলেছে সে। মান্তু একবার উঁকি মেরে  মুচকি হেসে চলে গেল। এই 'পিতা পুত্র', 'গরু-মোষ', 'চৌবাচ্চায় জল ভর্তি'র অঙ্ক  সে পার করে এসেছে। এখন পিন্টুর সে সব যন্ত্রণা ভোগের পালা।মান্তুু বাংলার নোটের খাতায় মুখ গুজে দুলে দুলে পড়তে লাগল মা বললেন... "কি রে মান্তু দুধটা দিয়ে গেলাম খাসনি। "সন্ধ্যার সময় রেল কোয়ার্টারের পাড়ার রাস্তা ঘাটে লোক জন কমই বের হয়। সবে সবে শীতের আগমণ হয়েছে।  দিনের  আলো  মিলিয়ে যায় দ্রুত  সঙ্গে সঙ্গে নিমন্ত্রণ আসে আঁধারের। সারা দিনের কর্ম ব্যস্ততার পর খানিক আলস্যতা আসে শরীরে। পাখির ঝাঁক ঠিক সময়ে ফিরে যায় নিজের বাসায়। সারাদিনের কোলাহলের মুখে আঙুল রেখে স্বল্প নিস্তব্ধতার মধ্যে চুপিসারে সাঁঝ বলে সায় অনেক কথা কিছু উদাসতা আবার কিছু সংকেত, দিন ফুরিয়ে যাওয়া সংকেত। হঠাৎ ঘরের ছাদে ধুপ ধাপ শব্দ শোনা গেল। ঝড় নয় শিলা বৃষ্টি নয় হঠাৎ এমন শব্দ। চারিদিকের পরিবেশও চুপ চাপ শুধু আসে পাশের বাড়ি থেকে টি.ভির নিউজ চ্যানেলের শিরোনাম শোনা যায় পাশের বাড়ির দাস জ্যাঠিমা কেবল সিরিয়াল দেখেন তাও হাই ভল্যুউমে সব মিলিয়ে বাতাবরণে একটা মিশ্র শব্দ ছড়িয়ে তারই মধ্যে রেল কোয়ার্টারের অ্যসবেস্টস ছাদের উপর শোনা গেল ধুপ ধাপ। পিন্টু অঙ্কের খাতা ফেলে ছুট্টে এসে মায়ের পেটের কাছটা জড়িয়ে ধরল। মা বলল ..."দাঁড়া ভয় করলে হয়।সামনের দরজাটা বন্ধ আছে তো। "দরজাটা বন্ধ দেখে বারান্দায় গিয়ে গ্রিলের ভেতর দিয়ে দেখে পেল্লাই পেল্লাই খান চারেক হনুমান তাদের কোয়াটারের বাগানে লম্ফঝম্প করে চলেছে। হনুমান দেখে পিন্টুর মন থেকে 'চোর ডাকাত' কিংবা ভুতের ভয় দূর হয়। সাহস তার সমহিমায় বেরিয়ে আসে। ও হনুমানকে আঙুল দেখিয়ে বলতে থাকে ..."এই হনুমান কলা খাবি। "
              সেই দিনের পর থেকে হনুমানের দল বারকয়েক আক্রমণ করেছে। দুপুর বেলা রবিবারের ছুটির দিনে সবাই এক সঙ্গে খেতে বসেছে। মটুসুটু পিন্টু আবার মুরগীর মাংসের ভক্ত। মা তা ভালোভাবেই জানেন মান্তু আবার মাছের। শীতের দুপুরে চারিদিকে নরম রোদের আস্তরণ। সবুজ গাছ পালা গুলো যেন সেই নরম রোদের স্নেহের ছোঁয়ায় আরও সতেজ হয়ে উঠেছে। অ্যাসবেস্টস ছাদে আবার সেই চেনা পরিচিত ধুপ ধাপ শব্দ। বাবার তাগড়াই চেহারা। লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ শরীরের পুরুষ মানুষ। এঁটো  হাত ধুয়ে সজোরে লুঙ্গিতে গাঁট দিয়ে "দাঁড়াত"বলে একটা লাঠি  নিয়ে বেরিয়ে এলেন। বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পাই পাই করে চারিদিকে লাঠি ঘোরাতে লাগলেন "আয় শালা তোরই একদিন কি আমারই। "বাগানের অবস্থা দেখে তারও মাথা গেছে ঘুরে। অনেক সাধ করে পেঁপে গাছ লাগিয়েছিলেন। বলেছিলেন ..."আমার হাতের ফলন ভালো হয়। ছেলে বেলায় অনেক গাছ করেছি। "সবে সেই গাছে ফুল এসেছে কয়েকটাতে তো কচি কচি পেঁপেও হয়েছে। বীর হনুমান রাবণের অশোক বাটিকা ধ্বংস করেছিলেন তা নয় ন্যায় সম্মত ও বীরত্ব প্রদর্শনের সাপেক্ষে যথেষ্ট অর্থ বহন করে কিন্তু এই হনুমানের দল কি কারনে তার সখের বাগান তছ নছ করে। হনুমান গুলো বাবার অমন মূর্তি দেখে লেজ তুলো দৌড়া দৌড়ি শুরু করে। এক জন ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সামনের পেয়ারা গাছের ডাল ধরে ঝুলে আবার এক লাফে পৌঁছে যায় দাস জ্যাঠিমার আতা গাছে আরেকজন  দু তিন লাফে পালায় পেছন পাড়ায় যোশীজির বাগানের জাম গাছের মগ ডালে ।বাকি গুলোর দল ভঙ্গ হওয়ায় এলোমেল ভাবে ছড়িয়ে  সামনের সুরকির রাস্তা ধরে পালায়। পাড়ার নেরি কুকুর গুলো উচ্চ স্বরে ঘেউ ঘেউ করে পিছু নেয়। বাবা তো বীরপুরুষের মতো হনুমানদের পরাজয় করে ঘরে ঢোকেন। পিন্টু বাবার কৃতিত্বে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে খাটের উপর উঠে লাফা লাফি করছে। মাও স্বামীর বাহাদুরীতে আপ্লুত হয়ে বলল ..."ভাগ্গিস্ তুমি বাড়ি ছিলে, রোজ ব্যাটারা আসে এই ভয় পেল আর আসবে না। "
         মান্তু সাইকেল করে টিউশুনি থেকে ফিরল। পিন্টু দিদির সাইকেল চালাবার বায়না ধরেছে..."দে না দিদি একটু চালাই।"মান্তুর শখের সাইকেল কোনও মতেই পিন্টুর হেফাজতে দেওয়া চলে না। সে বলল ..."ঠিকাছে তুই পেছনে বস আমি এক পাক ঘুরিয়ে আনব। "অগত্যা নিরুপায় পিন্টু রাজি হয়ে যায়। আজ আবার পারোমিতার সঙ্গে মান্তুর বাংলা নোট নিয়ে মন কষা কষি হয়েছে। জ্বরের জন্য মান্তুর দিন কয়েক টিউশুনি কামাই হয় তাই পারোমিতার কাছে নোটের খাতা চেয়েছিল কিন্তু সে কিছুতেই দেয়নি। 'বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের' নোট ছিল। মান্তুর মাথায় এখন 'বাংলার নোট' ঘুরছে।এক নোট বিনা সংসার পিছিয়ে পড়ে আরেক নোট বিনা বিদ্যালয়ের পড়া।পিন্টু সক্কাল সক্কাল  এক বাটি মুরী নিয়ে বসেছে জানলার ধারে হঠাৎ এক হনুমান পিন্টুর হাত খপাত করে ধরে তারপর বাটি নিয়ে দৌড়। পিন্টু তো ভ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করে। মান্তু বাবার বীরত্ব অনুসরণ করে লাঠি হাতে তাড়া করে। হনুমানও কি কম চালাক। পুরুষ মানুষ  অার বালিকার তফাত সে ভালোভাবেই জানে। পেঁপে গাছের পাতা গুলো মুড়িয়ে মুড়িয়ে  রোল করে এগরোল খাওয়া ভঙ্গিমায় তারা খেতে ব্যাস্ত। লাঠি হাতে মান্তুকে দেখে গাছ থেকে ঝুঁকে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করল। মান্তু ভয় লাঠি ফেলে "...ওরে বাবা  গো..."বলে ছুট্টে সোজা ঘরে। হনুমান এলাকার সবার বাড়িতেই নানা রকম উপদ্রব শুরু করেছে।ঘেটু কাকুর বৌ উঠনে ডালের বরি দিয়েছিল তাও খেয়ে ছড়িয়ে নষ্ট করেছে। এমন পরিস্থিতিতে এড়েদা থেকে এল পিন্টুর মামা। পুরুলিয়ার নিকট রেলের শহর জল হাওয়া ভালো তাই কিছু দিন দিদির বাড়ি থেকে হাওয়া বদল করতে অাসা। ছুটির দিনে দুপুরবেলায় খাওয়া সেরে মান্তু আর পিন্টু মামাকে ধরে গল্প শোনাও ..."দাঁড়া বাপু আমি গল্প টল্প শোনাতে পারব না। "পিন্টুও জেদ ধরেছে তবে ক্যারাম খেল। পাশেব় বাড়ির সুমনাদি আবার হাজির হল এক বাটি পায়েস নিয়ে। গোলগাল টুকটুকে ফর্সা গায়ের রঙের সুমনা মামার দিকে তল চোখে চেয়ে মা কে মৃদু হেসে বলল..."মা পায়েস পাঠিয়েছে। "যুবতীকে দেখে মামার হৃদয়ের ধ্বনি খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে ধনিত হতে লাগল। মামাও যুবক মনে মনে ভাবছে এই পায়েসের মাধ্যমে হয়ত যুবতী তার সঙ্গে বন্ধুত্বের একটা মধুর সম্পর্কের সূচনা করতে চাইছে। পিন্টু সুমনার হাত ধরে টেনে বলল ..."সুমনাদি চল না খেলি, ক্যারাম খেলা। "মামা তো খানিকক্ষণ আগে এই সব খেলাধুলায় বিন্দু মাত্র রুচি দেখাচ্ছিল না কিন্তু এই আগন্তুক যুবতী  তার সকল বিষয়ে রুচি বাড়িয়ে তুলেছে। মামা তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে ক্যারাম বোর্ড সাজিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। মামার পরনে একটা লাল গেঞ্জি  আর হাঁটু অবধি শর্টস। তরুণীর নজর বার বার মামার উন্মুক্ত ঠ্যাং এর দিকে যাচ্ছে আর সে মুচকে হেসে মান্তুর দিকে তাকাচ্ছে। মামা মাটিতে শতরঞ্চির উপর পা মুড়ে বসেছে বাঁ পায়ের পাতাটা ক্রমান্বয়ে নাড়িয়ে চলেছে। ক্যারামের একটা শট খেলে সুমনাকে জিজ্ঞাসা করল ..."তুমি কি পড়ছ ? "
..."এই বছর বিএ ফাইনাল ইয়ার, তুমি কি পড়? "
..."আমি লাস্ট ইয়ার পাস করেছি এখন ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢুকব।"সুমনা মান্তুকে বলল..."কাল সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যাবি। "মান্তু আনন্দে লাফিয়ে উঠল বলল ..."কি বই গো সুমনাদি। "
..."অ্যকশন মুভি আমার ভীষণ ভালো লাগে অ্যকশন হিরো আমার ফেভারিট। "পিন্টুও দু হাত তুলে নাচতে নাচতে বলল..."আমিও যাব। "মামা ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হাসি এনে বলল ..."সিনেমার অ্যকশন তো আসল অ্যকশন নয় ওগুলো সব অ্যানিমেটেড কম্পিউটার গ্রাফিক্স আমার তো রিয়েল অ্যাকশন ভালো লাগে। "সুমনা একটু রেগে গিয়ে বলল..."ওমা রিয়েল অ্যাকশন কোথায় পাব। "মামা পা দুটো সামনে সোজা করে মেলে আরমোড়া ভেঙে সুমনাদির দিকে জল জল দৃষ্টিতে তাকিয়ে  বলল..."কলেজে একটা ছেলেকে যা মার মেরেছিলাম না সে আজও ভোলেনি। "সুমনা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল ..."তা তো আমরা দেখিনি।"মামা সুমনাকে আরও ইমপ্রেস করার জন্য বলল..."আমি তো ক্যারাটে শিখেছি। "এমন সময় আবার ধুপ ধাপ শব্দ।পিন্টু চেঁচাল ..."আবার হনুমান..."সুমনা বলল ..."যান আপনার ক্যারাটে পরীক্ষার সময় এসে গেছে। "..."অনেক দিন ধরে তোরা বলছিস না হনুমান তিষ্টতে দিচ্ছে না। দাঁড়া আজ এমন বুদ্ধি করব হনুমান আর আসবে না। "মান্তু বলল ..."কি মামা? "
..."শুধু অ্যাকশন মুভি দেখলে হবে বুদ্ধিরও অ্যপলাই চাই। "বলে মামা ছুটে গিয়ে ড্রয়ার থেকে ছোট আয়না বের করে এনেছে। সুমনা বলল ..."এতে কি হবে? "
"আজ হনুমানের সামনে আয়না ধরব বলব দ্যাখ তোকে কেমন দেখতে। "মামা সুমনার প্রতি তার বুদ্ধি মত্তা আর বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য হাতে আয়না নিয়ে ছুটল বাগান। মামার পিছু নিল পিন্টু, মান্তু আর সুমনা। একটা বিশালায় হনুমান পেয়ারা গাছে বসে পেয়ারা খাচ্ছিল মামা আয়নাটা হনুমানের সামনে ধরল। হনুমান দাঁত মুখ খিঁচিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে মামার হাত থেকে আয়না নিয়ে এক চড় কষাল। মামাও সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারাল।
                   খাটের মাথার কাছে মান্তু পিন্টু মামার হাতের পাতাটা নিজের হাতে ধরে রেখেছে। সুমনাদি মুখের কাছে ঝুঁকে চেয়ে আছে। মামার জ্ঞান ফিরলেও ধুম জ্বর। মা ডাক্তার ডেকে এনেছেন। পরের দিন সুমনাদি বাড়ি এসে বলল ..."অ্যাকশন, ক্যারাটে তো অনেক হল এবার লক্ষ্মী ছেলে হয়ে দিদির আদর খাও। "মামার আর বীরত্ব প্রকাশের কোনও জায়গা নেই। হনুমানের চড়ে ও শুধু জ্ঞান হারায়নি ওর জ্বরও চলে এসেছে। বাবা দুপুরে অফিসের মাঝে দু প্যাকেট মুসাম্বি নিয়ে ঢুকলেন। হনুমানকে শায়েস্তা করতে আহত শালকের শুশ্রূষা দরকার সঙ্গে  একটা সংবাদ আনলেন। সকলকে সমবেত করে বললেন..."শোনও ঐ হনুমানের দলের একজন লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে গাছের ডালের মতো ইলেকট্রিক তারে ঝুলতে গিয়ে মারা পড়েছে।"শোনামাত্র মামা "অ্যাঁ"বলে উঠে বসল।
..."স্টেশনের সব কুলিরা তাকে সমাধিস্থ করেছে বলছে ওর সমাধির উপর বজরঙ্গবলীর মন্দির হবে। "মা ভক্তি ভরে প্রণাম করে বললেন..."হনুমান তো বজরঙ্গবলীর রূপ এচত্বরে একটাও বজরঙ্গবলীর মন্দির নেই। ভালো হল আমি শনি মঙ্গল বার যাব। "পিন্টু বলে উঠল ..."ভালো হয়েছে বদমাইসটা।"মা পিন্টুর মুখে হাত দিয়ে বললেন ..."না বাবা বলতে নেই ঠাকুর রাগ করবেন। উনি সঙ্কট মোচন হনুমান সব সঙ্কট দুর করবেন। "শত অত্যাচারের পর হনুমানের দল একটা মন্দির উপহার দিয়ে গেল। অশান্তি কাটিয়ে এলাকায় শান্তির হাওয়া ছড়িয়ে পড়ল। 

ব্লগে ব্যবহৃত ছবির সৌজন্যঃ-গুগল







বুধবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৭

নিয়তি

     
        বাজার পেরিয়েই বংশিদের মুদি দোকান। মস্ত বড় দোকান।দোকানে ঢুকতেই ডান পাশে ছিম ছাম চেহারার কমলা সাধু হাতে পেন আর কাগজ নিয়ে খদ্দেরের ফর্দ লিখতে সর্বক্ষণ ব্যস্ত অবস্থায় থাকে। দোকানে ভিড়ও ব্যাপক সব জিনিসের কোয়ালিটি এক নম্বর আবার জিনিস পিছু দামেও ছাড় মেলে। বড় ভাই রসিক সাধুর বয়স হয়েছে সে এক কালে দাপিয়ে দোকানদারি করেছে এখন ক্যাশের দায়িত্বটা নিজের কাছে রেখেছে। দোকানের সামনে বড় বড় চালের বস্তার খোলা মুখে কোয়ালিটি অনুযায়ী দামের লেবেল করা চৌক পিজবোর্ড রাখা। খদ্দেররা অনেকে হাতে চাল তুলে চালের আকার আকৃতি দেখছে অনেকে দাম দেখে আবার হাত ঝেড়ে চাল বস্তায় ফেলে চলে যাচ্ছে। খানিকটা ভিতরে ঢুকতে বস্তায় বস্তায় সারি সারি নানান রকম ডাল টিনের জারে তেল ঘি রাখা ।কর্মচারী ইলেকট্রিক ওজন যন্ত্রে ওজন করে সব জিনিস দিচ্ছে। দোকানের দেওয়ালে শোকেজে প্যাকেটের সব জিনিস ঠাসা। স্বল্প মূল্যের পাউচ প্যাকেট গুলো ঝোলানো রয়েছে। অনেক দিনের দোকান ।বংশী সাধুর বাপের আমলের বংশিও বেঁচে নেই কিন্তু তার নামেই দোকান চলছে। চারজন কর্মচারী আছে তাতেও মাসের প্রথমে মাসকাবারি করতে আসা খদ্দেররা যখন এক সঙ্গে এসে হামলে পড়ে তখন সামাল দিতে গলদঘর্ম হতে হয় সকলকে। কমলা সাধুর একমাত্র ছেলে রমেশ। রসিক সাধুর দুই মেয়ে তাদের বিয়ে হয়েগেছে অনেক বছর। এই দোকানের দায়িত্ব ভবিষ্যতে যার হাতে আসবে সে হল এই রমেশ। কিন্তু বাপ ঠাকুরদা  যে মেহনত করে এই দোকান দাঁড় করিয়েছে তার প্রতি কোনও মোহ মায়া নেই তার। সে তো প্রেমিক স্বভাবের। একান্নবর্তী পরিবারের এক মাত্র ছেলে যখন যা বায়না করে বাপ জ্যাঠা  তা দিয়ে দেয়। কষ্ট করে উপার্জনের সুখ মর্ম সে কিছুই জানেনা সে তো প্রেমিক তার প্রেমের স্বপ্নে উড়তে ভাল লাগে। গেল বছর জন্মদিনে বাপের কাছ থেকে  একটা বাইক আদায় করেছে। রসিক সাধু সেকেলের  মানসিকতার লোক ধমকে কমলাকে বলেছিল " যা মন চায় তাই কর এইভাবে ছেলের  মোহে ফুঁ দিয়ে টাকা ওড়ালে এক সময় কাঙাল হতে হবে। "সেই অতি শখের বাইকে চেপে দোকানে এসে উপস্থিত হল রমেশ। ইদানীং জ্যাঠা তার রকম সকমে বেশ অসন্তুষ্ট। রমেশ জ্যাঠা কে এড়িয়ে বাপের কাছে এসে ফিসফাস করছে। কমলা তার দাদা কে বলল ..."দাদা ওকে কিছু টাকা দাও না।"
..."কেন। ফুর্তি করতে এক পয়সা দেব না। "
..."জ্যাঠু কলেজ ফী। " এই বলে ক্যাশ বাক্সের উপর ঝুঁকে পড়ল রমেশ। দোকান ভর্তি লোক আর কর্মচারীদের সামনে কিছু বলতে না পেরে একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করল রসিক তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে আরেকটা জ্যাঠু বলে দুটো পাঁচশ নিয়ে বাইকে চড়ে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।
             রবিবার মাছের বাজারে নানা রকম মাছ ওঠে আজ আবার রসিকের মেয়ে জামাই আসবে। বাজারের থলি নিয়ে মাছের বাজারে ঢুকল। স্বভাবগত ভাবে হিসেবি রমেশ পাবদা, পার্শে, চিংড়ি যাই দর করে দাম শুনে পিছিয়ে চলে আসে। বাজার এখন কমলা আর রমেশ করে সে আসেনা বহুদিন তাই দাম গুলো যে এত বেড়ে গেছে তা হজম হয় না রসিকের। বড় ট্রে তে জলের মধ্যে চারা মাছ গুলো খাবি খাচ্ছে দামেও পোশায় কিন্তু মেয়ে জামাই আসছে। জামাই এর পাতে চারা মাছ দেয় কি করে। অনেক  দ্বিধায় মাংসের দোকানে লাইনে দিয়ে মুরগী কিনে বাড়ি ফেরে রসিক। কালবৈশাখীর সময় রোজ বিকেল হতেই মেঘে আকাশ কালো হয়ে আসে। চারিদিকে ধুলো উড়িয়ে ঝড় ওঠে। রমেশের বিকেলে ঋতুপর্নার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার প্ল্যান আছে। সেই স্কুলের  সময় থেকে নানা মেয়েদের সঙ্গে  প্রেম করে শেষমেষ এই ঋতুপর্না কে তার প্রেয়সী করে তুলতে চায় সে। মোবাইলে হোয়াটস  অ্যাপে মেসেজ এল..."কখন আসছ।"এপাশ থেকে রমেশ লিখল
..."পাঁচটায় বেরব। "সঙ্গে  সঙ্গে মোবাইল বেজে উঠল রমেশ হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে মিষ্টি কণ্ঠস্বরে ভেসে আসে ..."আগের বার পুরো দশ মিনিট দেরি করেছ এবার তার শাস্তি। "
..."শাস্তি ,এই শাস্তি কেন ওটা ট্রাফিকের জন্য দেরি হয়ে গিয়েছিল ।"
..."তা আমি জানি না তোমায় আগে থেকে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। "
..."জো হুকুম হুজুর। "বলে সশব্দে একটি চুম্বন রমেশ ফোনের এপাশ থেকে তার প্রেয়সীকে পাঠাল। 
          আলমারি খুলে ডেনিমের ব্লু জিন্স আর ঋতুপর্নার প্রিয় হলুদ রঙের টি শার্ট বের করল। বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ট্রিমার দিয়ে দাড়িটা ভলো করে ট্রিম করল তারপর হেয়ার জেল লাগিয়ে ব্যক ব্রাস করে চুল সেট করে নিজেকে নানা দিক থেকে ভালোভাবে দেখতে লাগল।ঋতুপর্না কেন? যখন ও বাইকে করে যাবে তখন যে কটা মেয়ে ফ্ল্যাট হবে সেটাই হল এখন চিন্তার বিষয়। বডি স্প্রে লাগাচ্ছে  এমন সময় রমেশের মা নাকে কাপড় দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল ..."কি সব ঝাঁ জালো গন্ধ গায়ে দিস বাবা এত গন্ধ আমার মাথা ধরে যায়। রোজই জামা কাপড় কাচছি তাতেও এসব দিতে লাগে। রমেশ কোনও গুরুত্ব না দিয়ে নিজের সাজেই মগ্ন।উনি বললেন ..."কোথায় যাচ্ছিস এখন? কি মেঘ করেছে খুব জোড় ঝড় আসবে।"
..."আমার দরকার আছে মা।"
..."কিসের দরকার এমন ঝড়ের মুখে আমি কিছুতেই  তোকে বেরতে দেব না। "
      রমেশ বিপদ দেখে কোনও রকম কথা বার্তায় না জড়িয়ে বাইকের চাবি নিয়ে তীরের বেগে বেরিয়ে গেল। বাড়ি থেকে বেরবার মুখে জ্যাঠার সামনে পরল রসিক চোখ মুখ কুঁচকে বলল..."এখন কোথায় বেরচ্ছিস ঝড়ের মুখে। "রমেশ জ্যাঠা কে এড়িয়ে বেরিয়ে  পড়ল। রসিক আপন মনে চেঁচাতে লাগল ..."এমন ঝড় বাদলের দিন, আমি বাইরে ফুল গাছের টব গুলো সব একধার করে রেখে এলাম,ওমা ঘরে ঢুকতে দেখি বাবু ফুলবাবু হয়ে চললেন ঝড়ের মধ্যে, যত সব। তোমরা বুঝবে আশকারা দিয়ে ছেলেকে মাথায় তুলেছ। "
       রাস্তার উপর বাইক ছুটছে চারিদিক ফাঁকা সামনে কালবৈশাখী তার কালো রূপের গর্বে ফুঁসছে। শুকনো হাওয়ার সঙ্গে রাস্তার ধুলো, শুকনোপাতা,প্লাসটিক আছড়়ে পড়ছে এদিক ওদিক। শুরু হল বৃষ্টি। রমেশ মেন রাস্তা ছেড়ে  গলিতে এসে উঠেছে। সামনে একটা বড় আম গাছের তলায় বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বার বার ঘরি দেখছে আজও সে লেট হয়ে যাবে। ঝতুপর্নাকে সামনের বকুল তলা স্টপেজ থেকে পিক করার কথা ছিল। কিন্তু এত বৃষ্টিতে ও কোথায় দাঁড়িয়েছে কে জানে। হঠাৎ শ্রবণ শক্তি বধির করে আকাশ চীড়ে তীব্র শব্দের সঙ্গে বাজ পড়ল।        দোকানে এক খদ্দের এসে বলছে ..."আগের বার যে চালটা দিলেন এবার সেই একই দামের চাল নিয়ে গেলাম কিন্তু অনেক তফাত। দাম এক কিন্তু পুরো ঠকেছি। "রসিক বলল ..."দাম এক হলে কোয়লিটি আলাদা হবে না। অনেক সময় ভাত সিদ্ধ করার সময়ের হেরফের হয় জল ঠিক থাকেন। "এই নিয়ে বচসা চলছে। এক খদ্দের এসে বলল ..."লিখুন দাদা মাল গুলো। "কমলা কাগজ পেন নিয়ে মুখে বলে বলে লিখতে শুরু করল..."মটর ডাল পাঁচশ,ময়দা এক কিলো, সাদা তেল পাঁচশ । "এক বয়স্ক মহিলা দোকানের বেঞ্চে বসে খানিক জিরিয়ে রসিককে জি জ্ঞাস করল ..."কি গো তোমাদের ছেলে কেমন আছে। " কমলার লিখতে লিখতে হাতটা থেমে গেল চোখ তুলে তাকাল। রসিক চশমা খুলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল ..."কি বলব দিদি অমন জলজ্যন্ত ছেলেটা পাষাণ হয়ে গেল। "
..."কি করবে বল সবই কপাল।এত বড় দোকান একটামাত্র ছেলে তার এমন অবস্থা। "
             সন্ধ্যার বাজারে হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে সবজি বাজারে এসেছে রসিক। বাল্বের আলোয় চটের উপর সবজি বিছিয়ে বসে আছে সবজি বিক্রেতা। শীতের সন্ধ্যা। চারিদিকের কুয়াশা ভেদ করে বাল্বের আলো এসে পড়ছে মাছ গুলোর উপর। সারি সারি মাছের রূপলী আস্তরণ পেরিয়ে  রসিক খানিকটা এগিয়ে গেল। বাজারে আজ প্রচুর ফুলকপি  উঠেছে। ব্যাগে বড় বড় তিনটে ফুলকপি কিনে টম্যাটো দর করছে এক জন পরিচিত ভদ্রলোক এগিয়ে এসে রসিকের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল ..."আরে রসিক কি খবর। "রসিক বলল ..."আরে দাস দা।"
..."তোমার ভাইপোর খবর শুনলাম। কি করে ঘটল এমন। "
রসিক খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল তারপর বলল ..."ঝড় বাদলের দিন ছিল একটা বড় আম গাছের তলায় বাইক নিয়ে দাঁড়িয়েছিল হঠাৎ জোরে একটা বাজ পড়ে অাম গাছের ডালে। ডালটা ভেঙে পড়ে রমেশের মাথায়। মাথায় চোট লেগে একেবারে ঘিলু বেড়িয়ে  আসে অনেক ঘন্টার অপারেশন করে কোনও মতে প্রাণে বাঁচে কিন্তু এখন পুরো পাষাণ। খাইয়ে দিলে খায় উঠিয় বসালে বসতে পারে। জোয়ান ছেলেটা বাচ্চা হয়ে গেছে। "বলতে বলতে রসিক আবার চশমা খুলে চোখের জল মুছতে লাগল। নিজেকে খানিক সামলে বলল ..."বড়দের কথা না শুনলে বড় মুশকিল সে দিন বার বার বেড়তে বারণ করেছিলাম শোনে নি। জলজ্যান্ত ছেলেটা পাষাণ হয়ে গেল।" 

ব্লগে ব্যবহৃত ছবির সৌজন্যে গুগল












বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৭

সম্পর্কের সমীকরণ





           চঞ্চলের আজকের দিনটা ভালোভাবে মনে থাকবে৷জোড়ে অটো চলছে দুপাশ থেকে নাকে মুখে হাওয়া ঢুকছে মনের ভেতরে একটা সন্তোষ বোধ হচ্ছে৷চঞ্চলের বড় দাদা অপরূপের বার কয়েক সম্বন্ধ ঠিক হয়েও ভেঙে গেছে৷অপরূপের বত্রিশ বছর বয়স হয়েছে আত্মীয় পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে কানাঘুষা নানা কথা শোনা যাচ্ছিল৷শেষ পর্যন্ত চঞ্চল তার পিসেমশাইয়ের সঙ্গে বাগুইহাটিতে এসে মেয়ে পছন্দ করে৷তারপর দেখাশোনা সেরে আজ বিয়ের দিন ঠিক করে বাড়ি ফিরছে৷
               চঞ্চল আর অপরূপ তিন বছরের ছোট বড়৷বরাবরই দুই ভাইয়ের ভাব৷অপরূপ ভাইয়ের অত্যাচারে আজ অবধি নতুন শার্ট কিনে  পরতে পারেনি৷নতুন শার্ট কিনলে আগে চঞ্চল পরবে তারপর দাদা৷এই আবদার ভালোও লাগত অপরূপের৷অপরূপ শান্ত স্বভাবের লাজুক প্রকৃতির আর চঞ্চল তার ঠিক উল্টো৷সামনে দাদার বিয়ে ছোট বেলায় তাদের বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তাই বিয়ের সব দায়িত্ব এখন দু ভাইয়েরই৷চঞ্চল বিয়ের কার্ডে নাম লিখছে আর বলছে "মা তুমি একটু সামলে এত উল্টো পাল্টা বক না আগের বার পেতলের পিলসূচ চাইতে গিয়ে একটা সম্বন্ধ কেটে গেছে৷"মাও ক্ষেপে উঠে বলেন—"হ্যারে একা তোদের বড় করলাম এখন তুই আমায় কথা বলা শেখাবি৷"অপরূপ এসে ভাই ও মায়ের মাঝে মধ্যস্থতা করে৷বিয়ের পর চঞ্চল বৌদি সুবর্নাকে সবসময় আগলে রাখে৷ যতই হোক সে সম্পর্কে ছোট দেওর কিন্তু সম্বন্ধ করে তো সেই বলতে গেলে দাদার বিয়ে দিয়েছে তাই তার দায়িত্বও অনেক৷ আবার দাদা বৌদির সঙ্গে বেশীক্ষণ সময় কাটালেও মুশকিল তখন বৌদির উপর রাগ হয়৷চঞ্চল যতই বিজ্ঞঁ হওয়ার চেষ্টা করুকনা কেন ছেলে মানুষি তো তাকে ছাড়ে না৷অপরূপ তা বোঝে তাই বেশীর ভাগ জায়গায় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে যায়৷কয়েক বছরের মধ্যে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানও আসে ওদের পরিবারে৷ভাইঝিকে পেয়ে চঞ্চলের আননন্দের সীমা থাকে না অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ছোট মুন্নীকে নিয়ে খেলায় ব্যাস্ত হয়ে পরে৷মুন্নীর জন্য ক্লিপ,সুন্দর সুন্দর ফ্রক,খেলনা সব চঞ্চল নিজে হাতে কেনে৷
       অন্নপ্রাশনের দিন বাড়িতে লোকজনের ভিড় তারপর নানান ছোটখাটো নিয়ম কানুন পালন করতে হচ্ছে৷মুন্নী সকাল থেকে কান্না জুড়েছে মাসি, মামা ,দাদু কেউ সামলাতে পারে না৷চঞ্চল ছুটে এসে বলল "আমায় দাও ও আমায় চেনে ৷"মুন্নী তো কাকাকে দেখে ঝাঁপিয়ে চলে গেল৷চঞ্চল গর্বে বুক ফুলিয়ে মুন্নীকে কোলে নিয়ে বেশ দুলকি চালে প্রস্থান করল ৷সবাই বলাবলি করল"ও  চঞ্চল তোর বৌতো খুব ভাগ্যবতী হবেরে কি সুন্দর বাচ্চা সামলাতে পারিস"৷চঞ্চলের জেঠিমা বলল"এবার এই ছোড়াটার বিয়ের ব্যবস্থা কর ৷"তারপর সব মহিলারা উলুধ্বনী দিতে লাগলেন৷
           কয়েক বছরে চঞ্চলেরও বিয়ে হয়ে যায় ৷মুন্নীর বছর তিনেক বয়স সেই অধিকারের ব্যাপার কাকার উপর কাকিমার অধিকার ছোট হলেও এব্যাপারে মুন্নী সজাগ৷কাকিমার উপর মাঝে মাঝে রাগ হয় কাকিমা বকলে মিছিমিছি কাঁদে পাছে কাকা এসে কাকিমাকে বকে৷চঞ্চলের ট্যুরের চাকরি মাঝে মধ্যেই অফিসের কাজে ট্যুরে যেতে হয়৷সেই কাজের জন্যই শিলিগুড়ি যায় সেখান থেকে সবার জন্য জিনিস নিয়ে আসে নিজে হাতে প্যাকেট খুলে সব জিনিস দেখাচ্ছে এমন সময় চঞ্চলের স্ত্রী শতরূপা বলে ওঠে "ঐ গোলাপি ছাতাটা আমার"সঙ্গে সঙ্গে মুন্নী বলে"না আমার"৷মুন্নীর কথায় সবাই হো হো করে হেসে ওঠে৷'আমার আমার'বলে মুন্নীকে কোলে তুলে চঞ্চল গোল হয়ে ঘুরতে থাকে৷বিয়ে হলেও মুন্নীর প্রতি চঞ্চলের ভালোবাসায় ভাটা পড়েনি৷ বর্ষার এক সকালে চারিদিকে বৃষ্টিভেজা ৷সকাল থেকে বৃষ্টি কাজের লোক আসেনি সুবর্না বাসন মাজছে শতরূপা বাটিতে দুধ রুটি নিয়ে খাওয়াচ্ছে৷মুন্নী শতরূপার পেটে হাত দিয়ে বলল" এতে কি আছে কাম্মা"৷শতরূপা মুন্নীর মুখে চামচ তুলে বলল"তোমার ভাই আছে"৷সুবর্না কলের গতি কমিয়ে বলল"কেন বোনও হতে পারে"৷
—"কেন দিদি তোমার মেয়ে বলে কি আমারও মেয়ে হবে নাকি৷"দুই জায়ে মাঝে মধ্যেই অধিকার আর শ্রেষ্ঠ্যতের ঠান্ডা লড়াই চলে যা স্বাভাবিকও বটে৷মাঝরাতে শতরূপার লেবার পেন ওঠে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়৷সকাল বেলা চারিদিক রোদ ঝলমল পরিষ্কার আকাশ কয়েকদিন পর শতরূপা ছেলে কোলে ঘরে ঢোকে৷চঞ্চল মোবাইলে ভিডিও করে ছেলের গৃহ প্রবেশ রেকর্ড করে৷উলুধ্বনি ফুল ছড়িয়ে চঞ্চলের পুত্রের গৃহ প্রবেশ হয়৷বাড়িতে আয়া রাখা হয়েছে মুন্নী ছুট্টে গিয়ে ছোট ভাইকে ধরতে গেলে আয়া চোখ বড় করে বলে "তুমি হাত ধুয়েছ যাও এখন ধরবেনা"৷অপরূপ খবরের কাগজ ফেলে ছুট্টে মুন্নীকে কোলে তুলে নেয়৷যে মুন্নীর সঙ্গে  কেউ উঁচু গলায় কথা বলে না সবসময় তোলা তোলা করে রাখা হয় তাকে চোখ রাঙাবে আয়া? এব্যাপারটা অপরূপের মোটেই সহ্য হয়না৷
            নদীর বেগের মত সময়ও অতিবাহিত হয় গতি আসে চঞ্চল -অপরূপের সংসারেও৷ মুন্নী আর গুবলুও একটু বড় হয়েছ৷মুন্নীর জেদ বায়নাও দিনে দিনে বেড়েছে স্কুল থেকে ফিরে মুন্নী ব্যগ ওয়াটার বোতল ছুড়ে ফেলে টিভির সামনে বসে পড়ে৷দিদিকে দেখে ছোট্ট গুবলু পাশে এসে বসে পড়ে৷দুজনে কার্টুন দেখতে মগ্ন৷চঞ্চল দেখতে পেয়ে ছুটে এসে টিভি বন্ধ করে বলে "খালি টিভি নিজের চোখ খারাপ করবি সঙ্গে ভাইটারও"৷সুবর্নার দেওরের আচরণ ভালোলাগেনা তা বিরক্ত প্রকাশের মধ্যে বুঝিয়ে দেয়৷ মুন্নীও উচ্চ স্বরে কাঁদতে শুরু করে৷ছোট্ট ঘটনা অহেতুক অসন্তোষের কারণ হয়৷এদিকে  মুন্নীর স্কুলের পরীক্ষার রেজাল্ট বেড়িয়েছে বেশীর ভাগ বিষয়েই সে  'C'পেয়েছে৷ অপরূপ আর সুবর্না খুবই চিন্তিত ক্লাস টুতে পড়ে যদি এখনই  এত খারাপ হয় তবে উঁচু ক্লাসে কি করবে৷সুবর্না অপরূপকে বলল "আমি বুঝতে পারিনা ওর কোথায় অসুবিধা পড়ার সময় তো সব বোঝে৷"শতরূপা আটা মাখছিল৷আটা মাখতে মাখতে এসে বলল"দিদি আমার মনে হয় ক্লাসে লাস্ট বেঞ্চের বাচ্চা গুলো থাকেনা কিছু পড়া বোঝেনা কিন্তু ভয়ে জিজ্ঞাস করে না তারপর পরীক্ষায় ফেল করে৷ মনে হয় মুন্নীরও সেরকম কিছু অসুবিধা হচ্ছে"৷চঞ্চলও আলোচনায় যোগ দিল "হুম ,শতরূপা চাইল্ড সাইকোলজি ভালো বোঝে৷বৌদি ও ঠিকই বলছে৷"রেজাল্ট বিভ্রাট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শেও কোনও সমাধান করতে পারে না৷
         মুন্নীর জন্ম দিনের অনুষ্ঠানে সব কচিকাচাদের ভিড়৷অনেক গিফটের প্যাকেট চকোলেটের বাক্স এলোমেলো ভাবে ছড়ান৷গুবলু এক একটা গিফট দেখছে চকোলেটের বাক্স খুলে দু একটা মুখেও পুরছে৷এই দেখে অপরূপ সুবর্নাকে ঈশারা করে  সব তুলে রাখতে বলে৷মেয়ের অধিকারে গুবলুর হস্তক্ষেপ বরদাস্ত হয়না অপরূপের৷অপরূপ মেয়ের ব্যাপারে হঠাৎই যেন বেশী সংবেদনশীল বা মেয়ের অধিকার নিয়ে হয়ত একটু বেশী রক্ষণশীল হয়ে ওঠে৷একদিন দুপুরে মুন্নী আর গুবলুর মাঝে টিভির রিমোট নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়৷গুবলু মুন্নীকে ধাক্কা দেয় মুন্নীও ধপাস করে পড়ে যায় ৷অপরূপ হঠাৎ রেগে গুবলুকে ধমক দেয়"বড় সাহস হয়েছে তোমার এত বড় দিদিকে মারছ"৷সঙ্গে সঙ্গে গুবলুও কান্না জোড়ে রিমোট যুদ্ধ ছোটখাটো তান্ডবের রূপ নেয়৷এই ভাবেই চলতে থাকে সকলের জীবন৷অপরূপ আর চঞ্চলের মধ্যের ভালোবাসা কোথাও যেন ভাগ হয়ে যায় হয়ত ভাগ হয়ে যায় ওদের সন্তানদের মধ্যে৷
        সুবর্না ছোট থেকে ভালো কবিতা বলত বিয়ের পর সেইসব চর্চা চলে গেছে তাই সেই সখ পূরণের জন্য মুন্নীকে কবিতার ক্লাসে ভর্তি করে দেয়৷শতরূপাও সময় নষ্ট না করে গুবলুকে গিটার ক্লাসে ভর্তি করে দেয়৷বাড়িতে লোকজন এলে মুন্নী কবিতার বই আর গুবলু গিটার নিয়ে অতিথী দর্শকদের মনোরঞ্জন করে সঙ্গে সঙ্গে চলে সুপ্ত প্রতিদ্বন্দিতা ৷  সামনে পুজো তাই অপরূপ আর সুবর্না পুজোর শপিংএ বেড়িয়েছে৷কলিংবেলের আওয়াজে মুন্নী দরজা খুলে দেখে পাড়ার পুজো কমিটির সভাপতি মনোজ দত্ত৷মনোছ বাবু বললেন "চঞ্চল এবার পাড়ার ছোটদের নিয়ে পুজোর অনুষ্ঠান করব তাই বলতে এলাম৷"
—"হ্যা জেঠু গুবলু paticipate করবে ও ভালো গিটির বাজাতে পারে"৷শতরূপা গুবলুকে বলল"যা বাবু যা গিটারটা নিয়ে আয়"৷গুবলু নাচতে নাচতে গিটার এনে মনোজ দাদুকে শোনাচ্ছে চঞ্চল পাশে দাঁড়িয়ে পেছনে হাত রেখে মনোসংযোগের সঙ্গে ছেলের গিটারের টুং টাং শুনছে শতরূপা মনোজ বাবুর জন্য চায়ের কাপ এগিয়ে উদ্বিগ্ন ভাবে ছেলের দিকে চেয়ে রইল৷মনোজবাবু খুশী হয়ে বলে গেলেন"বাহ্ চঞ্চল তোমার ছেলের তো খুব প্রতিভা ওর নামটা আমি নিয়ে নিলাম এবারের বিজয়া সম্মিলনীতে ওর একটা সোলো পারফরমেন্স থাকবে৷"বাড়ি ফিরে অপরূপ সব শুনে বলে "মুন্নীও তো কবিতা বলতে পারে ওর নামটা দিলি না"৷চঞ্চল বলল"কই মুন্নীতো কিছু বলল না"৷বিজয়া সম্মিলনীতে গুবলু পারফর্ম করল৷অপরূপ সেইদিনই পরিবার নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল সুবর্নার বাড়ি বিজয়া করতে৷
        দিওয়ালীতে বাচ্চারা বাজি পটকা ফাটাচ্ছে৷মুন্নীকে ডেকে পাড়ার অল্প বয়সী মেয়ে নিরূপা বলল "মুন্নী দেখ তোর ভাই সকাল থেকে আমাদের বাড়ির সামনে পটকা ফাটাচ্ছে কিছু বলতে যাব তখন পালিয়ে যাচ্ছে এগুলো কিন্তু ঠিক হচ্ছে না৷"মুন্নী নিরুত্তাপ ভাবে উত্তর দিল "আমার ভাই নয় খুড়তুতো ভাই"৷
                চঞ্চল আর অপরূপের সন্তানদের মাঝে এই 'তুতো'সম্পর্ক  সকলের অলক্ষ্যে তৈরী করেছে একটা অদৃশ্য দেওয়াল৷যার উচ্চতা দিনে দিনে বাড়বে  কিন্তু এই দেওয়াল না যাবে ভাঙা না যাবে পার করা৷

রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৭

বিজয়াদশমী






              মিষ্টির দোকানে বিশাল ভিড় বরুণ ঐ ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে কাঁচের শোকেজের উল্টোদিক থেকে সন্দেশে আঙুল রেখে বলল "এই সন্দেশগুলো ২০ টা আর রাজভোগ ২০ টা দিয়ে দাও৷"প্রচণ্ড গরম ভিড়ের মধ্যে  হাঁসফাস করছে৷আজ বিজয়াদশমী বাড়িতে ঠাকুমাকে বিজয়ার প্রণাম জানাতে আসবে সব আত্মীয়৷এবছর পুজো অনেক আগে হয়েছে৷ভাদ্র মাসের অস্বস্থিকর গরমটা  আশ্বিনের শুরুতে রয়েগেছে৷বর্তমানের গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রভাবে ঋতু বৈচিত্রেরও তারতম্য ঘটেছে৷বরুণের ঠাকুমার প্রায় পঁচাশী বছর বয়স পরিবারে উনই বয়ঃজ্যেষ্ঠ পিসি কাকারা সবাই আসেন বরুণদের বাড়ি ঠাকুমাকে প্রণাম করতে৷পুজোর চারটে দিন বরুনের ভালোই কাটে৷চারটে দিন কেন পুজোর আগে থেকেই পাড়ার পুজোর চাঁদা কালেকশন ঠাকুর আনা,ডেকরেটারদের তদারকি করা এসব ছোট খাটো কাজে পাড়ার বাকি ছেলেদের মত বরুণও যোগ দেয়৷তারপর পুজোর চারদিন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ঘুরে আড্ডা দিয়ে রোল খেয়ে ভালোই আনন্দে কাটে কিন্তু এই বিজয়া দশমী দিনটা বরুণের একদম না পসন্দ৷গ্র্যাজুয়েশনের পর প্রায় তিন বছর ধরে বরুণ বেকার বসে আছে৷এদিক ওদিক চেষ্টা করে কোনও মনপুতঃ চাকরি যোগার করতে পারেনি৷সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে হতাশা ছাড়া হাতে কিছুই আসেনি৷বিজয়ার  দিন বাড়িতে প্রচুর লোকের আগমন হয় প্রত্যেকের হাতে থাকে মিষ্টির প্যাকেট আর চোখে বরুণের প্রতি কৌতুহল৷এই অহেতুক কৌতুহলের কারণ হল বরুণের বেকারত্ব৷বরুণের বেকারত্ব যেন সকলকে তৃপ্তি দেয়৷এই কারণেই বিজয়া পর্ব তার না পসন্দ৷
               বাড়িতে ঢুকেই সিঁড়ির তলায় জুতো স্যণ্ডেল দেখে বরুণ আন্দাজ করে নেয় আত্মীয়দের আগমণ শুরু হয়েগেছে৷সিঁড়িতে উঠতে উঠতে ক্রমশঃ ভিন্ন ভিন্ন গলার স্বর স্পষ্ট হতে থাকে৷বরুণ মনে মনে বলল "বেহালার পিসি পিসে এসে গেছে"৷ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই এক মহিলা কন্ঠ স্বর ভেসে এল " কি রে বুড়ো কোথায় ছিলি এতক্ষণ"বরুণ একটু হেসে প্রণাম করে বলল"পিসি কেমন আছো?"
—"ভালো বস আমার পাশে"৷বরুণ বসল৷বরুণের পিসেমশাই অজিত সরকার কর্পোরেশনে উচ্চপদে কাজ করেন৷গোলগাল শ্যাম বর্ণের অজিত বাবু বরুণের পিঠ চাপড়ে জিজ্ঞাস করলেন "কি young manএখন কি করা হচ্ছে"৷এই প্রশ্নটা বরুণের কাছে সবথেকে বিরক্তকর৷বরুণ আশ্চর্য হয় সবাই জেনে শুনে কেন বার বার ওর বেকারত্বের ঘায়ে খোঁচা দেয় তারপর যখন নিশ্চিন্ত হয় যে বরুণ এখনও অবধি কিছু করে উঠতে পারেনি তখন পরম তৃপ্তি পায়৷বরুণ বলল "না সেরকম কিছুই না চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছি৷"এরপর অজিত বাবু বলতে থাকেন "না  না পরীক্ষা দিলেই হবে না যেখানে কাজ পাও ঢুকে পর ৷আগে ঢুকে পড়তে হবে৷অভিজ্ঞতা৷অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে৷বরুণ খানিকক্ষণ চুপ করে বিনামূল্যের পরামর্শ গ্রহণ করার পর উঠে যায়৷বাড়িতে হৈ চৈ হাসা হাসি চলছে৷বরুণদের দোতলা বাড়ি বাড়িটা ঠাকুরদার করা পুরনো দিনের বাড়ি চওড়া দেওয়াল উঁচু ছাদ ৷সামনের দিকের ঝুলন্ত বারন্দায় এসে দাঁড়াল বরুণ৷ঘরের মধ্যে বড্ড দম বন্ধ লাগছিল৷বরুণদের একতলায় ভাড়া থাকেন বসু পরিবার ৷বসুবাবু এক প্রাইভেট কোম্পানীর ইনসিওরেন্স এজেন্ট৷বসুবাবুর ছেলে ব্যাঙ্গালোরে অঙ্কে মাস্টার্স করছে৷যতক্ষণ পড়ছে যতক্ষণ engaged ততক্ষণ লোকে প্রশ্ন করে না প্রশ্ন শুরু হয় পড়া শেষ করার পর বা রেজাল্ট খারাপ হওয়ার পর৷গেটের সামনে আলো এসে পড়ল বরুণ একটু ঝুঁকে দেখল দিদি জামাইবাবু বাইকে করে হাজির৷
                  বরুণ আবার ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়াল ততক্ষণে বালিগঞ্জের বড় পিসি সল্টলেকের ছোট কাকা মেজ কাকা সবাই এক জায়গায় হয়ে গল্পের আসর ভালো জমে উঠেছে৷বরুণ চুপচাপ বসে মোবাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে লাগল৷বরুণের বাবা সরকারি চাকরি করেন আর্থিক অবস্থা মন্দ নয়৷বরুণের মা আর তাদের রাঁধুনী মিলে লুচি ভেজে সকলকে দিচ্ছে পিসি কাকিমারাও হাতে হাতে সাহায্য করছে৷চার বছরের বাবলু বরুণের কাছে গিয়ে বায়না করতে লাগল"মামা মোবাইল দাও গেম খেলব"৷বরুণ বাবলুকে চোখ রাঙাতেই বাবলু চিৎকার শুরু করে "ও কি চাইছে দিয়ে দে না বরুণ" এই বলে মেজ কাকা এগিয়ে এসে বাবলুকে কোলে তুলে নেয়৷খেতে বসে বরুণের ছোটকাকা বলল " বৌদি তোমার হাতের ছোলার ডাল আর ফুলকপির ঝোল এর তুলনা নেই ৷রমা তোমার ধারেকাছে আসতে পারবে না"৷রমা মানে বরুণের ছোট কাকিমা বলে উঠল "বাড়িতে তো দিব্যি চেটে পুটে খেয়ে নাও"৷বরুণের পাতে একটা লুচি দিয়ে বলল "বুড়ো ভালো করে খা,এখনই তো খাবি ইয়ং ছেলে৷তা এখন কি করছিস বাবা"৷বরুণ চুপ করে রইল৷বরুণের মা রান্নাঘর থেকে এসে বললেন "ও সরকারি চাকরির পরীক্ষা গুলো দিচ্ছে"৷
—"ও ভালো আমার দিদির ছেলে রাজু এই তো বরুণের বয়সী খুব চালাক ছেলে একটা বছরও নষ্ট করেনি এখন দিল্লীতে চাকরি করছে৷সামনের বছর দিদি বলছিল ওর বিয়ে দিয়ে একদম সেটেল করে দেবে"৷বরুণের মা একটা হতাশার সুরে বলল"আমার বরুণটার যে কবে গতি হবে"৷
—"চিন্তা করোনা দিদি সবাই তো সমান নয় ওরও হবে"৷বাবলুকে কোলে করে মেজ কাকা একটা চেয়ার টেনে বসল গম্ভীর সুরে বলল "দাদা বারান্দার দেওয়ালে ড্যাম্প ধরেছে তারপর কয়েকটা জায়গায় ফাটল দেখলাম"৷বরুণের বাবা ভাইদের মধ্যে বড় ধীর স্থির স্বভাবের বলল "হ্যা তাতো হবেই পুরোন বাড়ি"৷ছোটকাকা বেসিনের কলে হাত ধুতে ধুতে বলল"এখন কেউ পুরোন বাড়ি নিয়ে বসে থাকেনা দাদা৷প্রমোটারকে দিয়ে দাও তার আগে ভাড়াটে ওঠাবার ব্যবস্থা কর"৷বরুণের বাবা কিঞ্চিত চিন্তিত হয়ে বলল—"বাবার স্মৃতী এত বড় বাড়ি কয়েকটা ফাঁটলের জন্য প্রমোটারকে দেব৷সে তো সবাই মিলে সারাই করলেই হয়"৷
—"সবাই না,আমি নেই"৷এই বলে মেজকাকা লাফিয়ে উঠল৷"এই পুরনো বাড়িতে হাত দিতে গেলে অনেক খরচ আমি এখন টাকা বেড় করতে পারব না৷মেয়ে ম্যানেজমেন্ট পড়ছে তার জন্য ব্যঙ্ক থেকে লোন নিয়েছি"৷বাড়ি নিয়ে বাগবিতণ্ডা চলতে থাকে৷
            রাতে যে যার বাড়ি ফিরবে৷বরুণের ঠাকুমাকে নমস্কার করে একে একে সব বিদায় জানায়৷ছোটকাকা বরুণের ঠাকুমার চরণ স্পর্শ করে বলল "মা আজ আসছি ভালো থেকো"৷পঁচাশী বছরের বৃদ্ধা কম্পিত হস্তে ছেলের চিবুক ধরে ফ্যাকাসে দৃষ্টিতে বলল"আমি তো অনেক পুরোন হয়ে গেছি আমাকে কার কাছে দিবি৷"প্রশ্নটার উত্তর সেদিন কারো কাছেই ছিলনা৷
          ঘরের লাইট অফ করে খাটে শুয়ে শুয়ে বরুণ গুগল সার্চ করছে চাকরির ভ্যাকেন্সি দেখছে৷বাইরে ভালো হাওয়া ছেড়েছে জানলার পর্দা গুলো হাওয়ায় ফুলে উঠছে আবার হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জানলার গ্রিলে এসে ধাক্কা খাচ্ছে৷বরুণের মা বরুণের পাশে এসে বসল৷বরুণ মোবাইল পাশে রেখে মায়ের কোলে মাথা রাখল৷মায়ের ঠান্ডা আঙুল গুলো বরুণের চুল এলেমেলো করে দিল৷সারা দিনের কথায় প্রশ্নের আঘাতে ভারাক্রান্ত মাথাটা যেন পরম শান্তি পেল৷

বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৭

আলু কাবলী

           




                  রাস্তার উপর সারি সারি ছোট বড় দোকানের মাঝে সাদা সবুজ রঙ দিয়ে লেখা"নিরোগ প্যাথলজি সেন্টার" ৷এই প্যাথলজি ল্যাবেই কাজ করে অচিন্ত বর্মন৷ব্যস্ত রাস্তার উপর ল্যাব ৷আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে বেশীর ভাগ পরীক্ষা নিরীক্ষা অনত্র করাতে হয়৷সাধারণ রক্ত পরীক্ষা যেমন হিমোগ্লোবিন,টি.সি.ডি.সি,ই.এস.আর,ব্লাড সুগার,সোয়াপ,স্টুল,ইউরিন টেস্ট ইত্যাদি গুলো এখানেই হয়৷অন্য প্যাথলজির তুলনায় এই ল্যাবে ভিড়ও কম৷তবে সকালের দিকে ভালোই ভিড় হয় আর বিকেল পাঁচটা ছটা নাগাদ লোকে রিপোর্ট নিতে আসে৷অলস দুপুর অচিন্তের ঝিমিয়েই কাটে৷ল্যাবের সামনে একটা ফুচকায়ালা বসে৷ল্যাবের থেকে ফুচকার ঠেলায় ভিড় বেশী হয়৷অচিন্ত মাঝে মধ্যে  দাঁড়িয়ে পরে শাল পাতা হাতে নিয়ে ৷বেশ  কয়েক দিন হল অচিন্তর  ফুচকা আলুকাবলী খাওয়া হয় না৷বর্ষার সময় জল ভালো থাকেনা নানা জীবাণুর সংখ্যা বাড়ে তাই ঐ বর্ষার সময়টা শত ইচ্ছে হলেও অচিন্ত ঠেলার ছায়া মাড়ায় না৷বর্ষা পেরিয়ে শরৎ এর আগমন হয়েছে৷আকাশ বাতাসে শরৎএর হাওয়া৷কদিন ধরে  অচিন্তর মন চাইছে একটু আলুকাবলী খেতে৷কদিন ধরে কাজের চাপটাও বেড়েছে সময় বেড় করতে পারছে না৷একদিন বিকেল বেলায় এক পা দু পা করে হাঁটতে হঁটতে ঠেলার কাছে আসতে দেখে দুজন তরুনী অচিন্তকে দেখে একেঅপরের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে তাদের হাতের শালপাতার তলা দিয়ে তেঁতুল জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে৷অচিন্তকে এই এলাকার সকলে 'প্যাথোলজির লোকটা' হিসাবে চেনে৷তাই অচিন্তর কেমন একটু লজ্জা করল সে আবার ল্যাবে ফিরে গেল৷আজও তার আলুকাবলী খাওয়া হল না৷পরের দিন সকাল থেকে ল্যাবে খুব একটা ভিড় নেই ৷অচিন্ত আজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আজ ঠেলার সামনে যেই থাকুক আজ সে আলুকাবলী খেয়েই ছাড়বে৷ল্যাবে বসে সামনের রাস্তায় চোখ পড়তেই দেখে ফুচকায়ালা সেদ্ধ আলু গোল গোল করে কাটে তারমধ্যে লঙ্কা গুড়ো ,বিটনুন,তেঁতুল জল দিয়ে ভালো করে মেখে শালপাতায় ঠেসে ঠেসে ভরে উপর থেকে কুচনো ধনে পাতা আর লেবুর রস ছড়িয়ে দেয়৷আজ অচিন্তকে কেউ আটকাতে পারবেনা৷টক খেতে অচিন্ত বরাবর ভালোবাসে তারপর বর্ষার জন্য আলুকাবলীর সঙ্গে অনেকদিনের বিরহ আর সহ্য হচ্ছে না৷ভাবতে ভাবতে দেখে এক তন্বী সবুজ রঙের কুর্তি আর সানগ্লাস চোখে তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে৷অচিন্ত জিজ্ঞাসা করল "বলুন"৷তরুনী উত্তর দিল"আপনাদের এখান থেকে কেউ বাড়িতে রক্ত নিতে যায়৷ আমার ঠাকুমা অসুস্থ্য উনি এখানে আসতে পারবেনা"৷এই বলে তরুনী সানগ্লাস খুলতেই অচিন্ত বলল"পারোমিতা না?চিনতে পারছনা"৷তরুনীও হেসে বলল"ওমা অচিন্তদা তুমি"৷অচিন্ত পারোমিতার থেকে দুবছরের সিনিয়ার ওরা একই স্কুলে পড়ত৷অচিন্ত নিজে উদ্যোগ নিয়ে পারোমিতাদের বাড়ি গিয়ে তার ঠাকুমার রক্ত নিয়ে আসে৷রিপোর্ট পৌছেদেয় তারপর মাঝে মধ্যে ফোন করে কথা বলে দুজনে৷অচিন্তর একঘেয়ে জীবনে বসন্তের ছোয়া নিয়ে আসে পারোমিতা৷ল্যাব,সামনের রাস্তা ,ফোনের রিংটোন সবকিছুই হঠাৎ করে রোমান্টিক লাগতে থাকে অচিন্তর কারণ তার হৃদয়ে অনুপ্রবেশ করেছে পারোমিতা৷একদিন বিকেলে পারমিতা অচিন্তর ল্যাবে এসে বলল "কাল ঠাকুমার ইউরিন টেস্ট আছে একটা কন্টেনার দাও৷"অচিন্ত ড্রয়ার থেকে কন্টেনার বের করে পারোমিতার হাতে ধরিয়ে বলল"পারোমিতা আলুকাবলী খাবে?"পারোমিতা হেসে বলল"আলুকাবলী"
—"হ্যা চল না সামনের ফুচকায়ালা ব্যপক বানায় আমি ভীষন ভালোবাসি চল না"৷পারোমিতা একটু ভ্রূ কুঁচকে সামন্য  ইতস্তত  হয়ে বলল"না আমি না, তুমি খাও গো আমার আজ একটু তাড়া আছে৷"
              অচিন্তর একদিন মনে হয় মনের মধ্যে পারোমিতাকে না রেখে একবার বলেইদি যে আমার ওকে ভালোলাগে আর আমি ওর জন্য সিরিয়াস৷ফোন করে পারোমিতাকে বলে "পারোমিতা কেমন আছো"
—"ভালো আছিগো অচিন্তদা"৷
—"তোমার সঙ্গে আজ বিকেলে একটু দরকার ছিল আসতে পারবে?"
—"দেখছি "৷এই বলে পারোমিতা ফোন রাখে৷বিকেলে অচিন্তর ল্যাবে পারোমিতা কথামত আসে৷অচিন্ত বলে —"চল একটু ঘুরে আসি৷"
—"কেন তুমি তো বলেছিলে তোমার দরকার ছিল"৷
—"হ্যা বলছিলাম ,আসলে কদিন ধরে ভাবছিলাম তোমায় বলব পারোমিতা, আমার তোমায় খুব ভালোলাগে আমি তোমাকে....."পারোমিতা অচিন্তর কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই বলল "আমি এখন আসছি"৷অচিন্তর সব বোঝা হয়ে গেল৷পারোমিতার মুখের অভিব্যক্তিতে অচিন্তর মুখ শুকিয়ে গেল৷
                  অন্য ল্যাব থেকে  ব্লাডরিপোর্ট  আনে শেখরদা ৷শেখরদার মেয়ের জ্বর তাই অচিন্ত ঐ রিপোর্ট আনতে বাসে উঠেছে৷খুব একটা ভিড় নেই তাই একটা সিট দেখে বসে পড়ল৷বাস ঘটিবাড়ি স্টপেজে থামতে বাসের গেটে চোখ পড়তে অচিন্ত দেখল পারোমিতা এক বান্ধবীর সঙ্গে বাসে উঠল৷দুজনের চোখিচোখি হতে পারোমিতা চোখ সরিয়ে নিল৷বাস চলছে ফাঁকা বাস তাই বারবার অচিন্তর চোখ পারোমিতার দিকেই যাচ্ছে৷পারোমিতা তার বান্ধবীকে কথা শোনাবার ছলে বলল"জানিস তো অনুষ্কা কিছু ছেলে আছে দেখবি মেয়ে দেখলে হাঁ করে থাকে আর মেয়েদের মত আলুকাবলী ফুচকা খায় আমার এসব ছেলে গুলোকে একদম অসহ্য লাগে"৷এই বলে পরের স্টপেজে ওরা দুজন নেমে গেল৷অচিন্তর ভগ্ন হৃদয়ে আরেকটু আঘাত লাগলেও সে নিজেকে সামলে সেই দিনই একগোছা ব্লাডরিপোর্ট ব্যাগে করে নিয়ে বাস থেকে নেমে সোজা গিয়ে পৌছাল ফুচকায়ালার কাছে৷তখন দুজন মহিলা শালপাতায় চুমুক দিয়ে টক জল খাচ্ছে একজন যুবতী ফাউ এর অপেক্ষায়৷অচিন্ত তাড়িতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বলল"দাও ভাই আমায় ভালো করে আলুকাবলী মেখে দাও"আলুকাবলী হাতে নিয়ে অচিন্তর মনে হল আজ বিরহের দিন শেষ আলুকাবলী, আজ প্রানখুলে আমি তোমার স্বাদ নেব৷পারোমিতার টিপ্পনীর জন্য আমি আলুকাবলীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারব না৷

রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৭

বন্ধন

       

           শীতের রাত সকলের বাড়ির জানলা দরজা বন্ধ৷১৩/বি দেবেন্দ্র নাথ লেন একদম শুনসান৷স্ট্রীট লাইটের তলায় একটা নেড়ি কুকুর চেঁচিয়ে ঠান্ডায় গা গরম করছে৷ঐ কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে আসে পাশের পাড়ার দুতিনটে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না৷পাল বাড়ির ভিতরের পরিবেশটাও আজ নিঃস্তব্ধ৷বসুন্ধরা পাল তার স্বামী প্রকাশকে বলল"হ্যাগো,এমন দিন দেখব বলে কখনও ভাবিনি"৷প্রকাশ একটু হতাশ হয়ে বলল"না..."৷পাশের ঘরে  দরজার সামনে গিয়ে বসুন্ধরা ডাকল"কোয়েল... কোয়েল"৷কোনও উত্তর না পেয়ে ঘরে ঢুকে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে শুয়ে থাকা কোয়েলের  মাথায় হাত বুলিয়ে বলল"খেতে চল আর মুখ ভার করে থাকিস না৷তুই যা চাইছিস তাই করিস৷তোর বাবার আর আমার কোনও আপত্তি নেই৷"গায়ের থেকে কম্বল সরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল কোয়েল৷"সত্যি"৷—"হ্যা বাবা সত্যি এখন খাবে চল৷"
                  ইদানীং বসুন্ধরার কিছুই ভালোলাগেনা৷বসুন্ধরার একটা বুটিক আছে৷বুটিকের কাস্টমাররা বসুন্ধরার মিশুকে ব্যবহারের জন্য তার বাঁধা খোদ্দের হয়ে গেছে৷আজ বসুন্ধরার কোনও কাজে মন নেই৷এক অল্প বয়সী মহিলা কাঁথা স্টিচের উপর বিভিন্ন ডিজাইনার শাড়ি দেখতে চাইলেন৷বসুন্ধরা শাড়ি দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পরে এরই মধ্যে ঐ অল্পবয়সী মহিলার ছোট্ট ছেলে 'মা  মা  'বলে ছুটে ঐ ভদ্রমহিলাকে জড়িয়ে ধরতেই বসুন্ধরার বুকটা কেঁপে ওঠে৷একটা অজানা শক্তি অজান্তেই বসুন্ধরার মনটাকে দূরে উড়িয়ে নিয়ে যায়৷বর্তমান থেকে অনেক পিছিয়ে প্রায় পনেরো বছর আগে৷বসুন্ধরা আর প্রকাশের বিয়ের অনেক গুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও তারা সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিত ছিল৷ডাক্তার দেখাবার পর কিছু ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে প্রায় দিনই যেতে হত৷একদিন অন্যমনস্ক ভাবে হাসপাতালের লিফ্টের ভুল বোতাম টিপে উনি শিশুবিভাগে পৌঁছে যান৷বাচ্চাদের আকর্ষণে ঘুরতে ঘুরতে ভেতরে ঢুকে যান৷অনেক কচিকাচার মধ্যে গোল গাল চাঁপা গায়ের রঙের একটি ছোট্ট মেয়ে"মা...মা"বলে ডেকে বসুন্ধরাকে জড়িয়ে ধরে৷"মা তুমি এসেছ,আমি কবে থেকে তোমার জন্য বসে আছি"৷বসুন্ধরা চোখে জল ধরে রাখতে পারেনা শিশুটিকে কোলে তুলে বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদতে থাকে৷নার্স ছুটে এসে বলে—"আপনি চেনেন ওকে"
—"না সিস্টার কিন্তু ও আমায় মা বলছে যে"৷নার্স জানায় "ওকে ওর বাবা খুব অসুস্থ্য অবস্থায় আমাদের হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়৷প্রথম প্রথম দেখা করতে এসেছে তারপর বেপাত্তা৷আমরা অনেক খোঁজ করেছি কিন্তু ঠিকানা ফোন নাম্বার সব ভুল ছিল"৷বসুন্ধরা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল"তারপর ,তারপর কি হল?"
—"তারপর আরকি এখানকার ডাক্তার বাবুরা আর আমরা নার্সরা সবাই মিলে ওর দেখাশোনা করি৷ও যখন ওর মায়ের কথা জিজ্ঞাস করে তখন বলি একদিন তোমার মা ঠিক তোমায় নিতে আসবে কিন্তু আপনাকে দেখে এমন মা মা কেন করল কে জানে ও কিন্তু এরকম করে না৷"সব শুনে বসুন্ধরা বলল"তাহলে আপনি সব ব্যবস্থা করুন সিস্টার আমি সব আইন কানুন মেনে ওকে দত্তক নিতে চাই৷৷"ঐ হাসপাতাল থেকে চার বছরের ছোট্ট মেয়েকে দত্তক নেয় বসুন্ধরা ৷নাম রাখে কোয়েল৷বসুন্ধরা আর প্রকাশের জীবনে কোয়েল আসার পর ওদের জীবনের কেন্দ্র বিন্দু হয়ে ওঠে৷আর পাঁচ জন মা বাবার মতন তারাও স্নেহ দায়িত্বের সঙ্গে কোয়েলকে মানুষ করে৷মা বাবার স্নেহ মমতায় পুষ্ট কোয়েল আজ জেদ ধরেছে সে তার আসল বাবা মা কে খুঁজে বেড় করবে৷তাই বসুন্ধরার মন এত চঞ্চল আজ৷মনে হয় 'আসল বাবা মা'আমাদের পর করে দিলি কোয়েল৷প্রকাশ প্রথমে রাজি হয়নি কিন্তু মেয়ের জেদের কাছে পরাজিত হয়েছে৷কোয়েলকে সেই হাসপাতালের ঠিকানা দিয়েছে যেখান থেকে তারা ওকে এনেছিল৷কোয়েল যখন বড় হচ্ছিল সব বুঝতে শিখছিল তখনই বসুন্ধরা কোয়েলকে সব বুঝিয়ে ছিল৷বলেছিল কোয়েল ওদের পালিত কন্যা কিন্তু  বসুন্ধরা আর প্রকাশের জীবন কোয়েল ছাড়া অস্পূর্ণ৷তবু আজ কোয়েল তার বায়োলজিকাল প্যারেন্টস দের খুঁজতে চায়৷
                 কোয়েল হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে কোনও হদিস পায় না৷তবু সে তার সন্ধান অভিযান চালিয়ে যায়৷একদিন কাবার্ডের জামা কাপড় গোছাতে গিয়ে একটা প্যাকেট পায় বসুন্ধরা৷প্যাকেট খুলে কোয়েলের ছোট্ট বেলার সুন্দর কুঁচি দেওয়া গোলাপী ফিতের একটা ফ্রক পেল৷ফ্রকটা হাতে নিয়ে আবার অতীতে পাড়ি দিল বসুন্ধরা৷প্রথমবার স্টেজে উঠে এই ফ্রকটা পরে সুকুমার রায়ের 'নোট বই'কবিতাটা বলেছিল কোয়েল৷ভয়ে বার বার আমায় খুঁজছিল ওর চোখ আর আমি স্টেজের পেছন থেকে ওকে সাহস দিয়ে গেছি৷একটা গভীর শ্বাস ফেলে ভাবল তাহলে কোথায় ফাঁকি ছিল আমার যে আজ কোয়েল ওর আসল বাবা মাকে খুঁজতে মরিয়া হয়ে পড়েছে৷পাশের ঘর থেকে কোয়েল আর প্রকাশের মধ্যে কিছু নিয়ে তর্ক হচ্ছে৷প্রকাশের গলার স্বর ক্রমশ চড়ছে—"খবরের কাগজে দিয়ে কি হবে কোয়েল?তুই তো ফেসবুকে তোর ছোটবেলার ছবি হাসপাতালের নাম ঠিকানা সব দিলি কোনও response তো এলনা আবার খবরের কাগজ কেন?"
—"হয়ত ওদের ফেসবুক নেই কিন্তু খবরের কাগজ সবাই পড়ে"৷
—"তাদের ফেসবুক নাই বা থাকুক তাদের বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজন কেউই...."বসুন্ধরা প্রকাশের কথা কেটে বলল"ঠিক আছে ওর যা যা ইচ্ছে হচ্ছে ওকে করতে দাওনা৷"কোয়েল খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে রোজ অপেক্ষায় থাকত যদি কোনও আগন্তুক আসে তার খোঁজে কিন্তু কেউ এলনা৷ধীরে ধীরে কোয়েলের মাথা থেকে আসল বাবা মা খোঁজার ভূত নামল৷একদিন শীতের সকালে কোমল রোদে বসে বসুন্ধরা কোয়েলের মাথায় তেল মাখতে মাখতে বলল"হ্যারে কোয়েল আমাকে কি তুই নিজের মা বলে মানতে পারিস না"
—"কেন মা এ কথা কেন বলছ৷"
—"তবে যে তুই তোর আসল মা খুঁজতে বেড়িয়ে ছিলি৷"
—"অনেক ইচ্ছে হয়েছিল মা,একবার তাদের খুঁজে বের করি আর তাদের তোমার সামনে এনে বলি ভাগ্যিস তারা আমায় ঐ হাসপাতালে ফেলে চলে গিয়েছিল তাই তো আমি তোমায় পেলাম মা৷ওদের বলতে ইচ্ছে হয়েছিল আমায় ফেলে দিয়ে তোমরা আমার উপকারই করেছ৷আমি খুব সুখে আছি৷এই সুখ তোমরা আমায় কোনও দিনও দিতে পারতে না৷"এই বলে মা মেয়ে হেসে উঠল৷রৌদ্রজ্জ্বল শীতের সকাল তাদের হাসিতে আরও ঝলমল করে উঠল৷

বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সস্তা মেয়ে

            

             সুপ্রিয়া সকাল থেকে বার বার জানলার সামনে দাঁড়াচ্ছে মাঝে   মাঝে দরজাটা খুলে বাইরে বেড়িয়ে একটু পায়চারী করে আবার ঘরে ঢুকে পরল৷আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখে চোখে মোটা করে কাজল টেনে নিয়ে বিভিন্ন কোণ থেকে মুখটা পর্যবেক্ষণ করে চুলের সামনেটা ঠিক করছে এমন সময় বাইকের পিপ্ পিপ্ শব্দ শুনে ছুটে গেল৷বাইক আরোহীকে দেখে উচ্ছল হয়ে বলল"এই আজ আসতে দেরি করলে যে"৷বাইক আরোহী বাইক থেকে নেমে বাইকের চাবি আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে সুপ্রিয়াদের ঘরে ঢুকল৷সুপ্রিয়ার বয়স সতেরো কি আঠারো৷ভর যৌবনের এই বয়সে সকলেই রূপবতী হয় সুপ্রিয়াও যৌবনের রূপে ধনী৷
           এই বয়স আবার কিছু পরিবর্তন আনে সকলের জীবনে যেমন বার বার নিজেকে আয়নার সামনে দেখতে ভালোলাগে ৷এই বয়সের মেয়েরা প্রসাধনী ব্যবহার করতে শেখে তারপর বিউটি পার্লারে গিয়ে নতুন নতুন হেয়ার কাট,আই ব্রো প্লাগিং, হাতে নখ বড় করা এই সকল সখ জন্মায় যৌবনের হাত ধরে৷যৌবন মেয়েদের রূপের পরিবর্তন ঘটায় আর মেয়েরাও রূপ সচেতন হয়ে যায়৷ব্যসন দিয়ে ফেসপ্যাক তৈরী করে মুখে লাগায় চুলের জন্য মাথায় ডিম দেয়৷বাচ্চা বয়সে যেগুলো অসহ্য লাগে যৌবনের ছোঁয়ায় সেগুলো সহনীয় হয়ে যায়৷ছেলেদেরও পরিবর্তন হয় বইকি তারা শরীর সচেতন হয়ে যায় দেহ গঠণ করতে ব্যয়াম কসরত শুরু করে, পেশী প্রদর্শণ করে৷এগুলো প্রকৃতির নিয়ম৷মনের কোণায় একটা অচেনা অনুভূতি উঁকি দেয় ঐ অনুভূতি উপভোগ করতে করতে মনও স্বপ্নের ডানা মেলে পাড়ি দেয় অচেনা দিগন্তে৷এই অচেনা অনুভূতিকে পরিপক্ক হৃদয় প্রেম নামে চিহ্নিত করে৷প্রেমের আবেগে আনকোরা মন খারাপ ভালোর তফাৎটা বিচার করতে পারেনা৷অনেকেই হয়ত পারে কিন্তু সুপ্রিয়া বিচার বোধের দিকে বড্ড বেশী অপরিণত ছিল৷সুপ্রিয়ার ঐ বাইক আরোহী বিরাট বড়লোক বাড়ির ছেলে বাবা ব্যবসাদার সে একমাত্র সন্তান৷ইন্দ্রজিৎ সান্যাল৷পোশাক পরিচ্ছদ চালচলনে ইন্দ্রজিৎ কে দেখে যে কেউ ধনী পরিবারেরই বলবে কিন্তু চেহারার দিক থেকে সে একবারেই সাধারণ৷মানে বাহারী কায়দায় পোশাকের পরিবর্তে কম দামের প্যান্ট শার্ট পরলে তারদিকে হত দরিদ্রও দৃষ্টিপাত করবে না৷
             সোফায় বসে ইন্দ্রজিৎ সুপ্রিয়ার হাত টেনে পাশে বসিয়ে নিল৷দুজনে নিবিড় ভাবে একেঅপরের সংলগ্নে বসে৷সুপ্রিয়ার মা ঘরে ঢুকে একগাল হেসে বলল"ওমা ইন্দ্র কখন এলে,তোমার জন্য আজ লুচি করেছি৷"ইন্দ্র একটু বিরক্তির সুরেই বলল"না না লুচি ঠুচি খাবনা আজ সুপ্রিয়াকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাব"৷সুপ্রিয়া এক লাফ দিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল—"ইন্দ্র আমায় আগে বলনি তো"৷
—"এই তো বলছি যাও যাও তৈরী হয়ে নাও"৷
       সুপ্রিয়া তাড়াহুড়ো করে মেরুন রঙে উপর সোনালী জরির কাজ করা একটা সিন্থেটিকের সালোয়ার কামিজ পরে নিল৷কিন্তু ম্যাচিং নেল পলিশ আর লিপস্টিক ছাড়া তো সুপ্রিয়ার সাজই অসম্পূর্ণ৷ওরই মধ্যে  সুপ্রিয়া সুন্দর ভাবে নেলপলিশ লাগিয়ে ফ্যানের সামনে হাত দুটো মেলে ধরল৷ইন্দ্রজিৎ অপেক্ষার পাত্র নয় বাইকে চড়ে স্টার্ট দিয়েছে৷সুপ্রিয়াও পড়ি কি মরি দৌড়ে বাইকের পেছনে চাপল৷ইন্দ্র স্পীডে বাইক চালাচ্ছে৷সুপ্রিয়া ইন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে বলল"ইন্দ্র তোমার সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার স্বপ্নের মতো লাগে৷তোমার বাইকটা হল রূপকথার পক্ষীরাজের ঘোরা আর তুমি আমার perfect dream man"৷সিনেমা হলে বসে সুপ্রিয়া দেখল নেল পলিশটা পুরো থেবড়ে গেছে৷এবার সিনেমা দেখায় আর কি করে মনযোগ দেয়৷নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে নেলপলিশ তুলতে তুলতে সিনেমার স্ক্রীনে "The End"ভেসে উঠল৷
                সুপ্রিয়ার বাবা পেশায় স্কুলের ক্লার্ক নেহাতই শান্ত নিরীহ প্রকৃতির মানুষ৷সংসারে সব দায়দায়িত্ব ভালোমন্দ উনি তার স্ত্রীর উপর দিয়ে খালাস৷স্ত্রীর মুখের উপর কোনও কথা বলার সাহসও নেই তার৷বাড়ি ফিরে মেয়ের কথা স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করায় উনি জানান"সুপ্রিয়া ইন্দ্রর সঙ্গে সিনেমা গেছে ফিরতে রাত হবে"৷পছন্দ না হলেও সব কিছু চুপ করে মেনে নেয় সুপ্রিয়ার বাবা৷
               ইন্দ্রজিৎ পুজোর শপিং করিয়ে দিয়েছে সুপ্রিয়াকে৷দামী দামী ড্রেস,জুতো,পারফিউম আরও অনেক কিছু যা ক্লার্ক বাবা কোনও দিন দিতে পারত না৷এই সকল সামগ্রীর বিনিময়ে সুপ্রিয়া নিজেকে অনেকটাই সপে দিয়েছে ইন্দ্রের কাছে৷ইন্দ্র ইচ্ছে মত সুপ্রিয়াদের বাড়িতে আসে নিজের মনোরঞ্জন আর ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য সুপ্রিয়ার শরীরকে খেলার সামগ্রীর মতো ব্যবহার করে৷সুপ্রিয়ার বড়দাদা,মা,বাবা সকলেই সবকিছু নিজ স্বার্থে মেনে নেয়৷বড় স্বার্থ বা বড় আশা বড়লোক বাড়ির ইন্দ্র সুপ্রিয়াকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে৷
              শপিং এর প্যাকেট খুলে খুলে সুপ্রিয়া আনন্দের সঙ্গে সব ড্রেস গুলো একে একে দেখছে ,আয়নার সামনে নিজের গায়ে ধরছে ঠিক এমন সময় পাড়ার ছোট্ট মেয়ে চুমকি এসে হাজির৷
"কি করছ সুপ্রিয়া দি"এই বলে সে ঘরে ঢুকল৷চুমকি ইন্দ্রজিৎকেও ভালোভাবে চেনে৷বছর চারের চুমকিকে ইন্দ্র বলল"এই চুমকি একটা খেলা দেখবি"৷চুমকি আনন্দের সঙ্গে বলল "কি খেলা দেখব দেখব"৷ইন্দ্র নতুন জুতোর বাক্স থেকে একটা চকচকে হাই হিল ল্যডিজ স্যান্ডেল বের করে সুপ্রিয়ার ঠোঁটে হালকা করে আঘাত করল৷তারপর জোড়ে আরও জোড়ে হাসতে হাসতে বলতে থাকল"দেখ মজাটা দেখ"৷সুপ্রিয়ার ঠোঁট ব্যাথায় লাল হয়ে গেল তবু 'হি হি হি'করে হেসে ও ইন্দ্রর খেলায় অংশ নিল কোনও প্রতিবাদ করল না৷ইন্দ্রজিৎ চুমকির দিকে তাকিয়ে বলল"কিরে চুমকি খেলাটা মজার না"৷
                দিনের পর দিন এভাবেই চলে ওদের জীবন৷তারপর ধীরে ধীরে ইন্দ্রজিতের আসা যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়৷চারিপাশের লোকজনের আলোচনার বস্তু হয়ে দাঁড়ায় সুপ্রিয়া৷পরিস্থিতির অবনতি দেখে  সুপ্রিয়ার মা ইন্দ্রজিৎকে ফোনে অনেক অনুরোধ করে বাড়ি ডাকে৷ইন্দ্র বাড়ি এলে সুপ্রিয়ার মা বলে"ইন্দ্র এবার তুমি সুপ্রিয়াকে বিয়ে কর নানা রকম কথা কানে আসছে মেয়েটার বদনাম হয়ে যাচ্ছে"৷ইন্দ্র তীক্ষ্ণ ভাবে হেসে বলল"বিয়ে,আমি তো কোনও দিন বলিনি যে আমি সুপ্রিয়াকে বিয়ে করব৷"সুপ্রিয়ার মা হতচকিত হয়ে বলে"একি বলছ ইন্দ্র,আমি সুপ্রিয়াকে তোমার সঙ্গে খোলামেলা ভাবে মিশতে দিয়েছি কারণ আমি তোমায় বিশ্বাস করেছিলাম তুমি নিশ্চই...."সুপ্রিয়ার মায়ের কথার মাঝেই ইন্দ্র উঠে দাঁড়াল৷"আমি চললাম মাসিমা৷আমার অনেক সখের মধ্যে সুপ্রিয়া একটা সখ ছিল৷আর ওর মত সস্তা মেয়েকে বিয়ে করার কথা আমি কোনও দিনও ভাবিনি"৷ইন্দ্র ঘর থেকে বেড়তেই দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল সুপ্রিয়া৷ইন্দ্রর হাতটা ধরে বলল"ইন্দ্র তুমি আমায় কখনও ভালোবাসনি"৷চোখের তলায় কালি রোগাটে চেহারার সুপ্রিয়ার দুচোখ ভর্তি জল ছাড়া কিছুই ছিলনা সেদিন৷ইন্দ্র বিদ্রূপাত্মক ভাবে তাকিয়ে বলল"কি চেহারা করেছ গো"পিছন ঘুরে সুপ্রিয়ার মাকে বলল"ওর বিয়ের ব্যবস্থা করুন আমি খরচ দিয়ে দেব৷"এই বলে ইন্দ্র নির্বিকারে বাইকে চেপে তীব্র গতিতে সুপ্রিয়াদের বাড়ি থেকে চলে গেল৷ইন্দ্র চলে গেল সুপ্রিয়াকে ছেড়ে ইন্দ্রর জীবনে আজ সুপ্রিয়ার কোনও স্থান নেই৷
              অতি সহজে যে জিনিস আমরা পেয়ে যাই তার প্রতি কদর বা আদর কোনওটাই থাকেনা আমাদের৷তা সাফল্য হোক,অর্থ হোক বা অতি সামান্য সেলের জিনিস হোক৷সস্তার জিনিস যা স্বল্প মূল্যে পাওয়া যায় তার আকর্ষনে আমরা সবাই যাই কিন্তু যত্ন করে রাখি কষ্ট করে পাওয়া দামি জিনিসটা৷সুপ্রিয়াও ইন্দ্রজিতের কাছে সস্তার ব্যবহারের দ্রব্য হয়ে গিয়েছিল যাকে ইন্দ্র ব্যবহার করে গেল কিন্তু যখন সম্মান দেওয়ার সময় এল তখন পিঠ দেখিয়ে চলে গেল৷সময়ের গতিতে এই সকল ঘটনা অনেক পিছিয়ে যাবে৷সুপ্রিয়ার জীবনে ইন্দ্রর আধিপত্য এক সময় অতীত হয়ে যাবে৷ইন্দ্রও হয়ত কোনও দেবী মূর্তির সম্মুখে হাত জোড় করে কৃপাপ্রার্থী হবে৷কিন্তু অতি সহজলভ্য কোনও কিছুই কি বাস্তবে সম্মান পায় নাকি শুধুই সস্তা হিসাবেই থেকে যায়৷


শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

ডায়েরি

         
             "কাল রাত অবধি আমার ডায়েরিটা এই শোকেজের উপর ছিল আর এখন উধাও"৷এই বলে ভায়েরির খোঁজে বাড়ির সকলকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল মুকুল দে৷মেয়ে বৌ খানিক এদিক ওদিক খুঁজে আবার যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল৷এক সময় রেলের কর্মী ছিলেন মুকুল দে এখন অবসরপ্রাপ্ত৷অবসরের কয়েক বছর আগের থেকে উনি ডায়েরি লেখা অভ্যেস করেছেন৷তাতে অবশ্য দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপ লেখেন না ঐ ডায়েরিতে রোজকার বাজার দোকানের খরচের হিসেব নিকেশ লেখেন উনি৷খুঁজতে খুঁজতে হাঁটু গেড়ে বসে নিচু হয়ে খাটের তলা  শোকেজের তলা ভালো করে দেখলেন না..কোথায় গেল৷এমন সময় পাড়ার রাস্তা দিয়ে ঠেলা গাড়ি করে"সবজি...সবজি .."হাকতে হাকতে সবজিয়ালা উপস্থিত৷ডায়েরি খোঁজাবন্ধ করে  জানলায় উঁকি দিয়ে সবজিয়ালাকে জিঞ্জেস করলেন"পটল কত করে আর ঢেঁড়স কত করে দিচ্ছ?"
—"বাবু পটল ৩০ টাকা আর ঢেঁড়স ৪০"৷সবজির দর পোশাল না৷অাজ সকালে উনি বাজারে গিয়েছিলেন ব্যাগ ভর্তি বাজির করেছেন৷তাই পাড়ার সবজির দরের সঙ্গে বাজারের দরের তফাৎটা দেখে নিলেন৷আজ সকালে ২কেজির একটা কাতলা মাছ কিনেছেন স্ত্রী শর্মিলাকে বাজার থেকে ফিরে বলেছিলেন"আজ জিরের পাতলা ঝোল করো কদিন ধরে গ্যাস অম্বলের প্রকোপটা বেড়েছে"৷সকালে বাজারের হিসেব লিখতে গিয়েই ডায়েরির খোঁজ৷এরই মধ্যে পায়েল "মা আসছি"বলে কম্পিউটার ক্লাসের জন্য বেড়ল৷মুকুল নিজের মনে মনে বলতে লাগল মেয়েটাও তেদড় হয়েছে৷ছোটবেলায় বাবা বাবা করে ঘুরত এখন মায়ের ভক্ত হয়েছে৷বাপের কোনও কাজে আসেনা৷কাজের বৌ লতা ঝাঁটা হাতে ঘরে ঢুকে ফ্যানের সুইচটা বন্ধ করল৷মুকুল লতাকে বলল"ভালো করে ঝাঁটা দিয়ে সব তলা গুলো দেখতো একটা ডায়েরি পাচ্ছি না"লতা ঘরির কাঁটার মত ঝাঁটাটা এপাশ থেকে ওপাশ ঘুরিয়ে বলল"কই কিছু নেই তো"৷
             ডায়েরি খুঁজতে খুঁজতে পুরনো খবরের কাগজের মধ্যে থেকে কতগুলো পুরনো ডায়েরি পেল৷পটল ১০টাকা কেজি ঢেঁড়স ১০৷বাবা দিনে দিনে দাম বাড়ছে৷ডায়েরিটা পাওয়া গেলনা৷বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুকুলকে কাবু করেছে হাইব্লাড প্রেসার আর স্পনডিলোসিস৷মুকুলের আবার হোমিওপ্যাথিতে খুব বিশ্বাস৷ঘরির দিকে তাকিয়ে দেখল ঔষুধ খাওয়ার সময় হয়েগেছে কাপে অল্প জল ঢেলে ঔষুধের শিশি থেকে ফোঁটা গুনে গুনে ঔষুধ ফেলে খেয়ে নিল তারপর শিশি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল হোমিওপ্যাথি ওষুধের দামও দিনে দিনে বাড়ছে৷এই প্রেসারের ঔষুধের দাম ছিল৬৮টাকা লাফিয়ে লাফিয়ে দামবেড়ে হল ৮৫টাক৷খাটের উপর শুয়ে গড়াতে বেশ ভালো লাগে৷বেলা হয়েছে শর্মিলা এসে বলল"চান সেরে নাও আমার রান্না হয়ে গেছে"
—"বুঝলে ডায়েরিটা পেলাম না"৷শর্মিলা বিরক্ত হয়ে বলল"উফ্ কি করবে অত হিসাব করে"৷মুকুল অবসরের পর যা টাকা পেয়েছে তাতে একটা ২বেডরুম ফ্ল্যাট কিনেছে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছে৷ছোটজন এখনও পড়ছে৷তাদের সকলের ভবিষ্যত এখন পেনশন আর পোস্ট অফিসের এম.আই.এস এর উপর নির্ভর তার উপর বাজার দর আগুন৷
             যতই বেলা বাড়ুক মুকুলের স্নান করতে বড় আলস্য আসে৷মনে হয় সবথেকে পরিশ্রমের কাজ৷জানলায় উঁকি দিয়ে দেখে দুটো হুলো বিড়াল ম্যাও ম্যাও করে গজড়াচ্ছে৷দুজনই গা ফুলিয়ে লেজ ফুলিয়ে ঢোল৷সামনের বাড়ি থেকে কে বেশ জল ছুড়তেই দুজন পাঁচিল টপকে দুদিকে পালাল৷শর্মিলা পিঠে হাত দিয়ে ডেকে বলল"চোখের সামনে জিনিস থাকলেও দেখতে পাও না"৷এই বলে ডায়েরিটা মুকুলের সামনে ধরল৷

মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

অযথা দেরি

             "কি গো টিয়ার চব্বিশ বছর বয়স হল সম্বন্ধ না খুজলে পাত্র এমনি এমনি পাবে?"গিন্নীর প্রশ্নে একটু চিন্তিত হয়ে হাতের খবরের কাগজটা পাশে টেবিলে রেখে সোফায় গা হেলিয়ে অমর মিত্র বলে উঠল"পাত্র সন্ধানের উপায় তো অনেক আছে কিন্তু কোন উপায়টাকে বাছব তাই ভাবছি"৷গিন্নী গামছা দিয়ে মাথার চুল মুছতে মুছতে বলল"কেন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দাও না"৷সেই মত বিজ্ঞাপন দেওয়া হল৷বিজ্ঞাপনের ফলও ভালোএল৷ডজন ডজন চিঠি আসতে শুরু করল৷ঐ ডজন থেকে কিছু বাছাই চিঠির মধ্যে একজন ব্যাঙ্ক কর্মীর সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ হল৷
             অমর মিত্র চিঠিতে দেওয়া কনট্যাক্ট নম্বর থেকে মোবাইলে ডায়েল করতেই খানিক্ষণ"ওম জয় জগদীশ হরে..."বাজার পর একজন গম্ভীর সুরে হ্যালো বললেন৷অমর মিত্র এপাশ থেকে বললেন"আমি শ্রীরামপুর থেকে অমর মিত্র বলছি সম্বন্ধের ব্যাপারে ফোন করেছিলাম"৷
—"হ্যা বলুন"
—"তা এখানে শ্রীরামপুরে একদিন আসুন পাত্রী দেখে যান আপনার ছেলের বায়ো ডাটা আমাদের পছন্দ হয়েছে"৷
—"কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল আপনারা আগে আমাদের বাড়ি মানে ব্যারাকপুর ঘুরে যান"৷
         ফোন রেখে অমর গান্নীকে বলে"হ্যা গো এতো দেখছি উল্টো নিয়ম,পাত্র পক্ষই তো আগে আসে"৷গিন্নী বেশী গভীর চিন্তায় না গিয়ে বললেন"আজ কাল দিন বদলেছে ঘুরেই এসনা"৷অমর তার শালা আর ছোট মেয়ে তিতাসকে নিয়ে ব্যারাকপুর উপস্থিত হয়৷বড় একতলা বাড়ি সুন্দর ভাবে গোছ গাছ করা দামী ফার্ণিচার দিয়ে সাজানো৷ছিমছাম পরিবার ৷ভদ্রলোক একসময় খুবই ভালো চাকরি করতেন৷ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা দুজনেই অমর মিত্রের একটা ছোট খাট ইন্টারভিউ নিয়ে নিলেন৷তিতাস অনেক চেষ্টা করেও পাত্রের ঝলক পেলনা ড্রয়িং রুমে একটা ছবিও নেই৷রবিবার পাত্রের ছুটি তাই সেই দিন পাত্রী দেখতে আসার দিন স্থির হল৷রবিবার সকাল থেকেই টিয়াদের বাড়িতে নানা প্রস্থুতি চলছে৷পর্দা বদলান হল৷সযত্নে তুলে রাখা বোনচায়নার ফুলদানীটা বেড়িয়ে পড়েছে৷ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য তাজা রজনীগন্ধা আর গোলাপ ঐ ফুলদানীর শোভা আরও বাড়িয়ে তুলেছে৷সোফার লাল ভেলভেট কাভার পরাতে পরাতে অমিতকে যথেষ্ট  গলদঘর্ম হতে হয়৷সবকিছু ঠিক ঠাক এবার পাত্রের অপেক্ষা৷টিয়াকে খুবই মিষ্টি দেখতে তারপর ইংরাজীতে এম.এ করেছে৷কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে অতিথিদের আগমন হল৷তিতাস পাত্র দেখে ছুট্টে গিয়ে টিয়াকে বলল"দিদি কি দেখতেরে যেমন কালো তেমন মোটা তুই না করে দিবি "৷টিয়া কানে দুল পরতে পরতে বলল"রিয়েল লাইফে এরকমই হয় তিতাস,বলিউডের সলমান সম্বন্ধ দেখতে আসে না"৷টিয়া আর তিতাস হালে 'হাম্ দিল দ্যে চুকে সনম'দেখেছে৷তিতাস হতাশ ভাবে বলল"তবে আমার বিয়ে করে কাজ নেই ভগবান আমায় বাঁচিও"৷দেখাশোনা চলছে ৷সুশ্রী টিয়াকে দেখে পাত্র বেশীক্ষণ আবেগ চেপে রাখতে পারল না৷প্রানখুলে অফিস বাড়ির সব কথা বলতে বলতে ছেলেবেলার এক ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলল"আমি দুষ্টামি করে দাদুর তাড়া খেয়ে মামাবাড়ির গরুঘরে লুকিয়ে পরতাম"বলে একাই হাহা করে হাসতে থাকে তাকে সঙ্গ দিতে সবাই একে একে হি হি হা হা করে হাসে৷তারপর বেশ কিছুদিন গেল কিন্তু পাত্র পক্ষের থেকে কোনও খবর পাওয়া গেল না হয়ত পাত্র পক্ষ বলে তারা নিজেদের প্রয়োজনাতিরিক্ত গুরুত্ব দিচ্ছিল৷তিতাস হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে দিদির তো বোধ কম আছে ঐ হাতির ছানা যেন আর ফোন না করে সে আবার গোয়াল ঘরকে গরুঘর বলে৷অমরেরও তেমন পাত্র পছন্দ হয়নি তাই সে অন্যত্র মেয়ের সম্বন্ধ স্থির করে৷সুদর্শণ অবস্থাপন্ন পাত্রের সঙ্গে টিয়ার বিয়ে হয়ে যায়৷অষ্টমঙ্গলার দিন বাড়িতে মেয়ে জামাই এসেছে অমরের মোবাইল বেজে ওঠে৷হ্যালো বলতেই ফোনের ওপাশ থেকে গম্ভীর সুরে ভদ্রলোক বললেন"কি হল আপনারা তো আর যোগাযোগ করলেন না"৷অমর বুঝতে পারে ইনি সেই ভদ্রলোক৷"সে তো আপনাদের করার কথা ছিল৷আমরা ভাবলাম আপনাদের পাত্রী পছন্দ হয়নি তাই অন্যত্র সম্বন্ধ করলাম"৷ভদ্রলোক হতচকিত হয়ে সামান্য উত্তেজিত হয়ে বললেন"সে কি মশাই আমরা তো আপনাদের অপেক্ষায় ছিলাম,আমার ছেলেকে নিশ্চই আপনাদের ভালোলেগেছে তাই আমরা যথেষ্ট আশাবাদী ছিলাম"৷অমর শান্ত ভাবে বলল"কিন্তু মেয়ের তো বিয়ে হয়ে গেছে দাদা bad luck আপনি অযথা দেরি করলেন৷"

সিদ্ধান্ত

           


          আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে খুব দেরি হয়ে গেছে৷কাল রাতে  জোড় বৃষ্টি এসেছিল ঘুমটাও খুব গাঢ় হয়েছিল৷আয়নার সামনে ঝুঁকে চোখে eye liner টানতে টানতে মহুয়া বলে উঠল "মা টিফিন প্যাক করে দাও আমি এক্ষুণি বেড়ব৷রিক্সা ডেকে উঠে পরল মহুয়া৷আজ খুব দেরি হয়ে গেছে আজ আর বাসের জন্য দাঁড়াতে পারব না ট্যাক্সি করেই চলে যাব৷হাতে চক ডাস্টার বোর্ডে ছবি এঁকে ভঙ্গিল পর্বত বোঝাচ্ছে মহুয়া ৷সব ছাত্রীরা মহুয়াকে খুব মেনে চলে৷মহুয়া তার প্রত্যেক ছাত্রীকে যত্নের সঙ্গে পড়া বোঝায় কখনও বিরক্ত হয় না৷ধীর স্থির ধৈর্যশীল চরিত্রের মালিক  হল মহুয়া রায়৷স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাস স্ট্যান্ডে একজন ভদ্রলোক প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকেন৷মহুয়া ৫৬ নম্বর ধরে চলে যায়৷ঐ ভদ্রলোক কোন বাসে ওঠে তা মহুয়া জানেনা প্রায়দিনই লক্ষ্য করেছে ভদ্রলোক মহুয়ার দিকে একবার তো তাকাবেনই ৷বেশী বয়স না ভদ্রলোকের লম্বা ছিপ ছিপে চেহারা কিন্তু মুখটা কেমন তা দেখেনি মহুয়া ৷একজন অচেনা পুরুষ মানুষের মুখের দিকে হাঁ করে দেখতে কেমন যেন বাধো বাধো লাগে৷তবে ফর্সা গয়ের রং গোঁফ আছে৷বাড়িতে ফিরে আর কোনও কাজ করতে ভালো লাগেনা৷সাড়ী ছেড়ে গা ধুয়ে সোজা বিছানায়৷কানে হেডফোন লাগিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে কখন যে চোখ লেগে যায় টেরই পায়না৷
              সুলেখা মহুয়াদের স্কুলে নতুন বাংলার টিচার৷আজ মহুয়া আর সুলেখা একসঙ্গে বাড়ি ফিরবে৷বাসস্ট্যান্ডে রোজকার মত সেই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে৷৫৬ নম্বরে আজ সুলেখা আর মহুয়া উঠে পরল৷সুলেখা বলল"মহুয়া বাসস্ট্যান্ডের ঐ ভদ্রলোক তোমায় দেখছিল৷"মহুয়া লজ্জা পেয়ে বলল "দ্যাত্ কি যে বল সুলেখাদি"৷একদিন হঠাৎই বাসস্ট্যান্ডের অচেনা ভদ্রলোক মহুয়ার কাছে এসে এক নিশ্বাসে বলতে লাগল"নমস্কার,আমি আপনাকে রোজ দেখি আমার নাম কার্তিক ঘোষ আমি ট্রেজারীতে ক্লার্কের চাকরি করি আমার আপনাকে খুব ভালো লাগে"এই বলে পকেট থেকে একটা কাগজে ফোন নাম্বার লিখে মহুয়ার দিকে এগিয়ে বলে "এটা আমার contact number"৷এরপর থেকে বাসস্ট্যান্ডে তাদের দেখা হলেই হাসির বিনিময় কিছু আলাপচারিতা তারপর কথা গল্প বাস মিস হয়ে যাওয়া এবং হোয়াটসআপ ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধুত্ব তারপর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷এদিকে মা তো সব টের পায়৷একদিন জিঞ্জাসা করলেন"মৌ তোর বাড়ি ফিরতে প্রায়ই দেরি হয় কেন বলত"৷মহুয়াকে বাড়িতে মৌ নামেই ডাকা হয়৷মৌ একটু ইতস্তত করে বলে উঠল"কই দেরি না তো"৷তারপর খানিক সামলে"মা আমি একজনকে পছন্দ করি তুমি আর বাবা একবার দেখা করবে ওর সঙ্গে"৷কার্তিক তার বাবা মার সঙ্গে চলে আসে মহুয়ার বাড়ি৷মহুয়ার মাথায়  ঘন মোটা চুল কপালটা ছোট্টো মোটা মোটা ভ্রূ৷হাতে পায়ে লোমের আধিক্য একটু বেশী৷ফর্সা গায়ের রঙে হয়ত একটু বেশী লোমশ বলে মনে হয়৷মহুয়াকে দেখে কার্তিকের মা বললেন"আজ কাল ছেলে মেয়েরা নিজেই দেখাশোনা করে নিচ্ছে আমরা তো কিছুই নই৷তবে মেয়েদের গায়ে এমন লোম কিন্তু ঠিক লক্ষ্মীমন্ত লাগে না৷"মহুয়া বাবার অমতেই জেদ করেই কার্তিককে বিয়ে করে৷
               মহুয়া চাকরির সঙ্গে সংসার ভালোই সামঞ্জস্য করে চলে৷ব্যাগ ভর্তি বাজার করে কলিং বেল বাজাতে কার্তিক দরজা খুলেই প্রশ্ন করে"রিক্সার হর্ণের আওয়াজ পেলাম তুমি কি রিক্সা করে এলে নাকি?"মহুয়া ব্যাগ বোঝাই বাজার নিয়ে ঘরে ঢুকে আচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বলল"হ্যা গো এত বোঝা"৷সঙ্গে সঙ্গে কার্তিক গম্ভীর সুরে বলল"এসব আর  হবেনা রিক্সায় পয়সা নষ্ট আমি বরদাস্ত করব না"৷মহুয়া যেন প্রথম একটা হোঁচট খেল৷বিয়ের কয়েকদিন পরই মহুয়া দেখে কার্তিকের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে অথচ ভালোমন্দ খাওয়া চোখের সামনে দেখলে কোনও সময়ই সংযম করতে পারেনা তাই স্বামীর স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে সেও পাতলা ঝোল ভাত খেয়েই থাকে৷দুটো ছেলে মেয়ে হয়ে গেছে তারাও বাবার ভালো স্বাস্থ্যের জন্য লুচির বায়না করতে পারেনা৷একদিন লুচি করার অপরাধে কার্তিক সব খাবার ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল তার সঙ্গে তুমুল অশান্তিও করে৷মহুয়া রিক্সা করলে বাড়ির সামনে দাঁড় করায় না দূরে রিক্সা ছেড়ে বাকি পথ হেঁটে বাড়ি আসে৷কার্তিক জানলে আবার অশান্তি করবে৷পুজোর ছুটিতে সবাই মিলে পুরি বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান হয়৷অনেকদিন পর বাইরের হাওয়ায় যদি রোজকার অশান্তি থেকে কিছুদিন ছুটি পাওয়া যায় এই আশা নিয়ে ছেলে মেয়ের হাত ধরে ট্রেনে উঠে পরল মহুয়া৷হোটেলের রুমে ভোর বেলায় ঘুমন্ত কার্তিকের মাথার আলতো করে  হাত বুলিয়ে  কানের কাছে আস্তে করে মহুয়া বলল"শুনছো চলনা এক সঙ্গে sun rise দেখে আসি"৷কার্তিক মুখটা বিরক্ত করে ওপাশ ফিরে শুয়ে পরল৷দুপুর বেলা ছেলে মেয়েদের পছন্দের খাবার অর্ডার করে মহুয়া হঠাৎ দেখে একজন অপরিচিত মহিলার সঙ্গে কার্তিক খুব সাবলিল ভাবে কথা বলছে যেন অনেক দিনের চেনা৷মহুয়া কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করল "উনি কে গো"কার্তিক খোশ মেজাজে বলল"ও সুস্মিতা এখানেই আলাপ হল শোন আমি কাল ওর সঙ্গে কোনারক যাচ্ছি৷৷"মহুয়া যেন এবার একটা জোড়ে ধাক্কা খেল৷বাড়ি ফেরার সময় ট্রেনে কলেজের বন্ধু দেবরাজের সঙ্গে দেখা হল মহুয়ার৷"আরে দেব কেমন আছিস কত বছর পর দেখা"৷অনেক দিন পর পুরনো বন্ধুকে দেখে পুরনো দিনে ফিরে গিয়েছিল মহুয়া৷প্রাণখুলে হেসেছিল সেদিন৷বাড়ি ফিরতেই কার্তিক সব কিছু ছুড়ে ছুড়ে ফেলছে"ট্রেনে ঐ বজ্জাত লোকটার সঙ্গে অত হাসা হাসি করছিলে কেন এই তোমার চরিত্র "বলে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ওঠে৷মহুয়া মাথা ঠান্ডা রাখতে না পেরে চিৎকার করে বলে"চরিত্র..চরিত্রের সার্টিফিকেট তুমি দেবে"৷প্রথমবার মহুয়ার কাছ থেকে জবাব শুনে রাগে কার্তিক মহুয়ার গালে সজড়ে এক থাপ্পড় মাড়ে৷ছোট মেয়েটা ভয়ে কেঁদে ওঠে৷মহুয়া স্তম্ভিত হয়ে খাটে বসে পড়ে৷ছেলে মেয়ের প্রতি কুপ্রভাব পরবে ভেবে মহুয়া চুপ হয়ে যায়৷
            কার দোষ আমার?আমি জেদ করে এই লোকটাকে বিয়ে করেছিলাম৷আমি আমার সুন্দর জীবনটাকে নিজে হাতে তছ নছ করলাম৷এখন স্কুলের মেয়েদেরও আগের মত গুছিয়ে পড়াতে পারিনা৷একটা প্রশ্ন কেউ দুবার জিজ্ঞাস করলেআমি বিরক্ত হই৷স্কুল থেকে বাড়ি ,বাড়িতে এসে অমানুষিক পরিশ্রম করি রিক্সার পয়সা বাঁচাই৷আমি বদলে যাচ্ছি,আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি,শুধু এই লোকটার জন্য?এই অজস্র চিন্তায় মাথাটা ভার হয়ে আসে মহুয়ার৷হঠাৎ কলিং বেল বাজে দর্জা খুলে দেখে"বাবা এস এস ভর দুপুরে এত রোদে কেন এলে বাবা৷"মহুয়ার বাবার চোখ মুখ শুকনো বললেন"আমি retire করেছি পেনশন নেই কিন্তু কষ্টে শিষ্টে তোর মায়ের আর আমার খরচ চালাবার মত আমার ক্ষমতা আছে রে মৌ তাই তুই মাস গেলে তোর মায়ের হাতে আর খরচের টাকা দিস না"৷"কেন বাবা হঠাৎ এমন কথা কেন বলছ আমার এমন কথা শুনলে বড় কষ্ট হয়৷"মহুয়ার বাবা সেদিন জল পর্যন্ত না খেয়ে চলে যায়৷পরে মহুয়া জানতে পারে কার্তিক ওদের বাড়িতে গিয়ে টাকা পয়সার ব্যাপারে খুব চিৎকার চেঁচামিচি করেছে এমনকি পাড়ার লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল৷
               স্কুলে সুলেখাদি মহুয়াকে বলে"কিরে মহুয়া কেমন শুকনো দেখাচ্ছে শরীর খারাপ৷" "সুলেখাদি আজ তোমার সঙ্গে যাব মায়ের সঙ্গে অনেক দিন দেখা করিনি৷"বাসে বসে মহুয়া সুলেখাকে বলে"সুলেখাদি আমি বোধ হয় কার্তিকের সঙ্গে সম্পর্কটা টানতে পারব না৷এই বলে হঠাৎ বাসের জানলার দিকে চোখ পড়ে, দেখে ফুটপাথের ঝুপড়িতে এক কম বয়সী স্ত্রীলোক চিৎকার করে ঝগড়া করছে আর তার স্বামীকে বার বার ধাক্কা দিয়ে অনর্গল গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে আসে পাশের লোকজন সবাই ঐ স্ত্রীলোককেই সমর্থন করছে৷ট্রাফিকের জন্য বাসটা ক্ষানিকক্ষন দাঁড়িয়েছিল তাই এ দৃশ্য দেখল মহুয়া আর সুলেখা৷মহুয়া বলতে লাগল— "ও যখন আমার বাবা মা কে অপমান করেছে তখন ওর সঙ্গে থাকা মানে আমি আমার রুচী শিক্ষা সংস্কার সব কিছুর অপমান করছি৷" —"বোকামি করিসনা মহুয়া তুই ব্যাঙ্কে হোম লোন নিয়ে বাড়ি করলি তাও আবার কার্তিকের নামে ৷এখন বলছিস আলাদা হবি৷"
— "কেন সুলেখাদি ঐ ফুটপাথের ঝুপড়ির মেয়েটার যদি সাহস থাকে তবে আমার কেন থাকবে না৷"
—"আরে ও তো লেখা পড়া জানেনা একটা ছোটলোকের সঙ্গে তুই নিজেকে গুলোচ্ছিস৷"
—"হ্যা গো সুলাখাদি ঐ মেয়েটা অক্ষর চেনেনা কিন্তু ঠিক বেঠিক জানে প্রতিবাদ করতে জানে বিচার পেতে জানে"৷
           সকালবেলা ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে মহুয়া কার্তিকের সামনে ধরে৷খবরের কাগজের শেয়ার বাজারের খবরে মগ্ন কার্তিক খবরের কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞাস করল"কি এটা"মহুয়া একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল"আমি সই করে দিয়েছি তুমি সই করলে ডিভোর্সটা মিউচুয়ালী হয়ে যাবে ৷না হলে কোর্টে গেলে বৃথা সময় নষ্ট হবে৷"কার্তিক ঔদ্ধত্য হয়ে বলে"তোমার খুব সাহস হয়েছে আমায় ডিভোর্স দেবে"৷মহুয়া আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে "সাবধান"রাগে অপমানে খেঁকিয়ে বলে" আমি টাকা পয়সা খোরপোশ কিচ্ছু দেব না"৷মহুয়া তাচ্ছাল্যর সঙ্গে হেসে বলল"তোমার মত হা ঘরের ছেলে দেবে আমায় টাকা পয়সা এই বাড়িটা আমি তোমায় তোমার আশ্রয় হিসাবে দান করে গেলাম৷"এই বলে দুই ছেলে মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে গেল মহুয়া৷
           সকালবেলা  ঠাণ্ডা একটা হাত মহুয়ার কপাল স্পর্শ করল৷"মৌ আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি করলি মা"৷মহুয়া ওর মায়ের হাতে চুমু খেয়ে বলল"না মা এত দিন পর আমি ঠিক সময়ে উঠেছি"৷

পুরনো দিন

         


            অনেকদিন পর এদিকে এলাম হ্যা প্রায় দশ বারো বছর তো হবেই৷ফুটপাথের উপর হাঁটতে হাঁটতে প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরাল বিবেক৷সিগারেটে টান দিয়ে ধুয়ো ছাড়তে  ছাড়তে চারিদিকটা দেখতে বেশ লাগছে৷একেবারে অামূল পরিবর্তন হয়েছে রাস্তা ঘাট দোকান পাট সব বদলে গেছে৷আজ থেকে দশ বারো বছর আগে বিবেক এই রাস্তা দিয়ে কত গেছে তখন সে কলেজ স্টুডেন্ট৷সামনেই কলেজ একটু এগিয়ে কলেজের সামনে যেতেই মনে পরে গেল পুরোন সব স্মৃতি৷কলেজটা নতুন রঙ হয়েছে গেটের সামনে পড়ুয়াদের ভিড়৷কলেজের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে একটা সোজা রাস্তা এই রাস্তা ধরে আবার মেন রোডে ওঠা যায়৷মেন রোডে উঠে ফুটপাথ ধরে বিবেক আবার হাঁটতে লাগল৷ফুটপাথের পাশে একটা চাউমিনের ঠেলা ছিল বিবেক আর অর্পিতা এখানে অনেকবার এসেছে৷ঠেলা এখন দোকানের রূপ নিয়েছে৷এই দোকানের বেঞ্চে বসে বিবেক বলল দাও ভাই এক প্লেট চাউমিন৷অনেক কিছু বদলে গেছে ঠেলা দোকান হয়েছে ছোট দোকানগুলো বড়  হয়েছে৷পুরনো ইঁট বার করা একটা পেল্লাই বাড়ি ছিল সামনের গলিতে সেটা এখন পাঁচতলা ফ্ল্যাট হয়ে গেছে এখন তো প্রোমোটারের যুগ চলছে৷দোকানদার চাউমিনের প্লেটে টমেটো সস ঢেলে বিবেকের হাতে ধরাল এক চামচ চাউমিন মুখে তুলে বিবেকের হঠাৎ মনে পরে গেল অর্পিতা আর বিবেক প্রায়ই আসত এখানে সেই সময় পকেটে বেশী পয়সা থাকতনা তাই এক প্লেটে দুজনে ভাগাভাগি করে খেত৷অর্পিতা খুব ফুচকা খেতে ভালোবাসত ওকে খুশী করতে বিবেকও দাঁড়িয়ে পরত ফুচকার লাইনে৷ এখন এখানকার পরিবেশটা অন্যরকম হয়েগেছে সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে অর্পিতার সঙ্গে সম্পর্কটাও বদলে গেছে এখন কোনও যোগাযোগ নেই ৷বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারা গেছে অর্পিতার বিয়ে হয়ে গেছে৷এখন নাকি কেরালাতে থাকে৷বিবেকও বিবাহিত৷বিবেকের হঠাৎ মনে পরে ফুটপাথের ওপারে একটা চায়ের গুমটি ছিল আর ওখানে একটা পাগল বসে থাকত৷যেই চা খেতে আসত সে পাগলটাকে অর্ধেক খাওয়া সিগারেট দিলে পাগল আপন মনে টান দিত৷চাউমিনের দাম মিটিয়ে বিবেক উঠল চা এর গুমটির দিকে৷গুমটির থেকে পাগলের খোজ করাটাই অবশ্য  আসল উদ্দেশ্য৷কালো জীর্ণ চেহারা বড় বড় চুল খোচা খোচা দাড়ি মাটি ভর্তি বড় নখ৷অর্পিতা বেজায় ভয় পেত৷ ওকে দেখে বিবেকের হাতটা চেপে ধরত৷অল্প বয়সে একজন ভয় নিবৃত্তির জন্য ওর ভরসা করছে ভেবে নিজের মধ্যে পুরুষত্ব ভাবের প্রকাশ পেয়ে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যেত৷চা এর গুমটির সামনে এসে দেখল বিগত বারো বছরে গুমটির কোনও পরিবর্তন হয়নি৷শুধু চাওয়ালার ছোট ছেলেটা জোয়ান হয়েছে৷এক ভাঁড় চা হাতে নিয়ে চুমুক দিয়ে বিবেক এদিক ওদিক তাকাল খানিক দূরে পাগল বসে আছে৷সব বদলে গেলেও কিছু কিছু জিনিসের কোনও পরিবর্তন নেই৷বিবেক পকেট থেকে সিগারেট বের করে  পাগলের সামনে ধরল৷

সুন্দরী বৌ

           ছেলেবেলা থেকেই দুই ভাইয়ের মধ্যে পড়াশোনায় ভালো ছিল ঘনশ্যাম বাগচী৷বাগচী পরিবারে আয়ের উৎস হল সদানন্দ বাগচীর মুদী দোকান৷দোকানে যা আয় হয় তাতে স্ত্রী গায়েত্রি বাগচী ও দুই ছেলের ভালোমন্দে চলে যায়৷এই পরিবারের খুবই কাছের মানুষ হলেন গায়েত্রির আপন দাদা রঘুবীর রথ৷ বোনের প্রতি রঘুবীরের ভালোবাসা উপমা দেওয়ার মত৷
              পড়াশোনায় ভালো হওয়ার দরুন ঘনশ্যাম মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে মুম্বাইতে ভালো চাকরি পেয়ে যায়৷বরাবর ঘরকুনো ঘনশ্যাম কোলকাতা ছেড়ে মুম্বাই যেতে চায়নি কিন্তু বাবার চাপেই তাকে যেতে হয়৷নিজের মুদি দোকান হলে কি হবে ছেলে ইঞ্জিনিয়ার একথা ভাবলেই  সদানন্দ বাগচীর ছাতি চওড়া হয়ে যায়৷তাদের বাড়ির দুঘর পরেই রায়দের বাড়ি৷এককালে বিশাল অবস্থা ছিল৷পাড়ার সবাই বড়লোক বলেই জানত৷সব সময় বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত বাড়ির সামনে কিন্তু ছেলেরা ব্যাবসা সামলাতে না পাড়ায়  এখন অবস্থা খুবই পড়ে গেছে৷ঐ রায় বাবু একদিন তার বড় কন্যা শ্রীতমার সম্বন্ধ নিয়ে আসে..."বাগচীদা আপনার বড় ছেলে ঘনশ্যামকে আমার বেশ পছন্দ৷শ্রীতমার জন্য ওর কথা ভাবছিলাম৷তা আপনি কি বলেন"৷শ্রীতমা রীতিমত সুন্দরী গৌরবর্ণা পাতলা চেহারা লম্বা চুল নাক মুখ চোখা৷সদানন্দ তো আকাশ থেকে পড়ে ঘনশ্যাম বেঁটে কালো চেহারার৷মোটা নাক মোটা ঠোঁট৷এমন ছেলেকে শ্রীতমা পছন্দ করবে?সদানন্দ বলে..."রায়দা আপনি যখন বলছেন তা নিশ্চয় ভেবে চিন্তে বলছেন ঠিক আছে এই দিওয়ালীর ছুটিতে ঘনা এলে আমি আপনাকে জানাব৷
             সদানন্দ খাটে শুয়ে পড়ে স্ত্রীকে বলে..."দেখলে লেখা পড়া শিখিয়ে ইঞ্জিনিয়ার করেছিলাম বলে অত বড় লোক বাড়ির মেয়ের সম্বন্ধ এসেছে"৷এমন সময় রঘুবীর বাজারের ব্যাগ হাতে হাজির৷ঘরে ঢুকেই বলল..."আজ বোনটার কথা বড্ড মনে পড়ছিল বাজারে ভালো কোলাঘাটের ইলিশ উঠেছিল তাই নিয়ে এলাম৷সঙ্গে মিষ্টি দইও এনেছি..."বাজারের ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে গায়েত্রিকে বললেন..."ধর ধর ভালো করে সর্ষে দিয়ে ভাপা ইলিশ করত"৷সদান্দ উঠে বসে বলল..."বলি ভালো দিনে এসেছো দাদা আজ তো বড় ভাগ্নের সম্বন্ধ এসেছে"৷রায় বাড়ির সুন্দরী মেয়ের সম্বন্ধ পেয়ে তো বাগচীদের আনন্দের অন্ত নেই৷
              দিওয়ালীর সময় চারিদিকে বাজি পটকার আওয়াজ৷সন্ধ্যেবেলায় ঘনশ্যাম পাত্রী দেখতে গেল৷সেইদিন সারা রাত ঘনশ্যামের স্বপ্নের মত লাগছিল৷অমন স্বপ্ন সুন্দরী হবে আমার বৌ তারপর বড়লোকের মেয়ে৷এখন হয়ত অবস্থা পড়েগেছে কিন্তু বড়লোকি চালেই মানুষ হয়েছে৷বিয়ের পরও ঘনশ্যামের বিশ্বাস হয়না এমন সুন্দরী বৌ তার নিজের৷শ্রীতমার জগ থেকে গলায় জল ঢেলে খাওয়া৷সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক ভাবে হাসা সবই ভালোলাগে ঘনশ্যামের৷কিন্তু কোথাও যেন বাধো বাধো পাছে বৌ যদি রুষ্ট হয়৷গায়েত্রিও বৌকে খুব যত্নে রাখে কোনও কাজ কর্ম করতে দেয়না৷হাটুঁ ব্যাথা কোমর ব্যাথা নিয়েও রান্না বান্না সব নিজেই করে৷একদিন সিনেমার টিকিট কিনে আনে ঘনা৷সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যায়৷সিনেমার হলে ইন্টারভলের সময় শ্রীতমা মাথার যন্ত্রণায় হল থেকে বেড়িয়ে যায়৷ঘনশ্যাম বৌয়ের পেছন পেছন ছোটে৷কোল্ডড্রিঙ্ক মাথা ব্যাথার ঔষুধ কি করলে মাথা ব্যাথা কমবে৷ সবচেষ্টায় বিফল হয়ে তারা বাড়ি ফিরে যায়৷ছুটির মেয়াদ শেষ ঘনশ্যম মুম্বাই ফিরে যাবে৷পরের বার এসে শ্রীতমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে৷এদিকে রঘুবীরের হঠাৎ স্ট্রৌক হওয়ায় গায়েত্রি দাদার বাড়ি চলে যায়৷গায়েত্রির দাদা মারা যায়৷থম্ থম্ এ মুখ নিয়ে গায়েত্রি বাড়ি ফিরে আসে৷ছোটবেলা থেকেই দাদা গায়েত্রির বড় কাছের মানুষ ছিল এই শোকটা সামলাতে পারছিলনা সে৷খুব কাঁদতে ইচ্ছে  করছে অথচ কাঁদতে পরছে না৷চোখ দুটো রক্তের মত লাল হয়ে রয়েছে৷খাটের এক কোণায় চুপচাপ বসে আছে৷এমন সময় ঘনশ্যাম ঘরে ঢুকে বলতে থাকে..."মা শ্রীতমা আমার সঙ্গে মুম্বাই যাবে ও এখানে থাকতে চাইছেনা।কান্নাকাটি করছে ওর আবার কান্নাকাটি করলে মাথা ধরে। "গায়েত্রী এবার কেঁদে উঠল কান্না কিছুতেই থামাতে পারছে না৷শত চেষ্টা করেও ওনার কান্না থামানো যাচ্ছেনা তারপর হাসি একই ভাবে হেসে চলেছে অনেক বকাবকি করে মুখে জল ছিঁটিয়ে ওনাকে স্বাভাবিক করা হয়৷ঘনশ্যাম ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে বৌকে সঙ্গে করে সেইদিনই মুম্বাই রওনা দেয়৷
           নতুন সংসার ঘনশ্যাম অফিস থেকে ফিরেই বৌএর মুখের দিকেই চেয়ে থাকে৷এমন সুন্দরী বৌ পেয়ে মনে মনে গর্ব হয় তার৷একদিন রাত২টো নাগাদ ঘনশ্যামের মোবাইল বেজে ওঠে৷তাড়াতাড়ি করে ফোন ধরে বেড রুম থেকে বেড়িয়ে ড্রয়িং রুমে যায়৷ফোনের ওপাশ থেকে দাদা শোনা মাত্রই বলে ওঠে..."কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই তোদের এত রাত্রে কেউ ফোন করে তোর বৌদির পাতলা ঘুম তারপর আজ ওর শরীরটা ভালো নেই ৷যদি তোর বৌদির ঘুম ভেঙে যেত৷"ফোনের ওপাশ থেকে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে..."দাদা মা আর নেই মা মারা গেছে"৷ঘনশ্যাম খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল ড্রয়িং রুমের সোফায়৷তারপরে আস্তে করে উঠে বেড রুমের দরজাটা সন্তপর্ণে বন্ধ করে শুয়ে পড়ল৷

অশ্বত্থ গাছ



       সরকারি চাকরির পরীক্ষার ফলাফলে not qualified দেখতে দেখতে হতাশ হয়ে পড়েছে অনু৷খোলা ছাদের নিচে একটা মাদুর পেতে শুয়ে উন্মুক্ত রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে কোনও হিসাবই মেলাতে পারছেনা সে৷কেন কোয়ালিফাই করতে পারছিনা৷গ্র্যাজুয়েশনের পর ৩বছর ধরে ঘরে বসে আছি  শুধু একটা সরকারি চাকরির আশায়৷ছোটবেলা থেকে কোনও দিন তো ফেল করিনি তবে এখন কেন এমন হচ্ছে৷কোচিং ক্লাসে স্যার বলেছেন.১ নম্বরের জন্যও নাকি পিছিয়ে পড়তে হয় কি জানি সমস্যাটা কোথায়৷
        সকালে উঠে লিকার খেতে খেতে পড়ে ,রাত জেগে কফি মগে চুমুক দিয়ে দিয়ে পড়ে, কোচিং পাল্টে ,কোচিং ক্লাসের সব নোট মুখস্থ করেও যখন কোনও ফল পাওয়া গেল না তখন অনুর মা স্মরাণাপন্ন হলেন এক জ্যোতিষীর কাছে৷পাড়ার মন্দিরা বৌদির কাছ থেকে পাওয়া ঠিকানা নিয়ে অনুকে সঙ্গে করে উপস্থিত হলেন জ্যোতিষীর বাড়ি৷বেশ বড় বাড়ি৷বসার ঘরে তাদের আগেও দুজন বসে অপেক্ষা করছে৷এরপর অনুদের পালা আসে৷জ্যোতিষী মশাই একটি ল্যাপটপ টেবিলের উপর রেখে চেয়ারে বসে আছেন৷অনুর মা বললেন"নমস্কার আমি আমার মেয়ের জন্য এসেছিলাম"৷গম্ভীর সুরে জ্যোতিষ বাবু বললেন"মেয়ের নাম ডেট অফ বার্থ"৷সব শুনে ভ্রূ দুটো কপালে তুলে বললেন"শনির সাড়ে সাতি চলছে৷"সাড়ে সাতি মানে কিছুই জানেনা অনু৷অনুর মনে হল যেন কোন রাক্ষস তার কপালে নাচছে তাই পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করতে পারছেনা৷অনুর মা চিন্তিত হয়ে বলল"উপায় বলুন আমরা এখন কি করব"৷
—"গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থা খুব একটা ভালোনা৷প্রচুর বাঁধা রাহুর অবস্থা ভালোনা৷এদিকে বৃহস্পতি দুর্বল হয়ে পড়েছে৷রবির ঘরে রাহু"৷
—"আপনি উপায় বলুন"৷
—"আপনি একটা পান্না ৬থেকে৭ রত্তির দিয়ে দিন"৷
—"পান্না তা কত খরচ পড়বে"৷
            জ্যোতিষ বাবু যা এস্টিমেট দেন তা শুনে অনুর মা জ্যোতিষীর ফি ৩০০ টাকা দিয়ে বাড়ি চলে আসে৷মনে মনে ভাবতে থাকে অত টাকা নেই এখনই অত খরচ করতে পারব না৷কোচিং ক্লাসে ভর্তি বাবদ একেবারে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে৷এদিকে যা সব শুনে এলাম তাতে চুপ করে বসেও থাকতে পারিনা৷পড়াশোনায় এত ভালো মেয়েটা ঐ সাড়ে সাতি না কি হাতির জন্য মেয়েটার কিছুই হবেনা৷সন্ধ্যে বেলায় পাড়ার কালী মন্দিরে গিয়ে পুরোহিত মশাইকে বললেন"ঠাকুর মশাই মেয়েটার জন্য কি করি সরকারি চাকরির কত চেষ্টা করছে কিছুই হচ্ছেনা৷ঠাকুর মশাই বিধান দেন চাকরি পেতে গেলে প্রতি শনি বার অশ্বত্থ গাছের নিচে সর্ষের তেলের প্রদীপ জ্বালাতে হবে৷অনুর মা খুশী হয়ে বাড়ি ফিরতেই অনুকে বলল"মা কালির কাছে সব উপায় আছে মাকেই সব ঠিক করে দিতে হবে"অনু অবাক"সে কি  মা ,মাকালি তোমায় দর্শন দিয়েছে নাকি গো"৷অনুর মা অনুকে সব বিস্তারিত ভাবে জানায়৷পরের দিন সকাল বেলায় জল খাবারের রুটি ঘুগনি খেতে খেতে অনু জিজ্ঞাস করল"মা চারিদিকে এত ফ্ল্যাট অশ্বত্থ গাছ কোথায়?"অনুর মা বললেন "খুজলে তো ঈশ্বরও পাওয়া যায় আর অশ্বত্থ গাছ পাবি না৷"
             খুজেপেতে অনু একটা বিশাল অশ্বত্থ গাছ পেল কিন্তু ঐ গাছের পাশে একটা চায়ের দোকান ৷সব চ্যংড়া ছেলেদের ভিড় ওখানে কি প্রদীপ জ্বালা যায়৷মাকে এসে বলে কি করা যায় বলত ৷আমি এখন ঘুমলেও স্বপ্নে অশ্বত্থ গাছ খুজি৷অনুর মা বললেন"সব গাছ কেটে ফ্ল্যাট বাড়ি দোকান রাস্তা হবে তো কি হবে তাই অশ্বত্থ গাছও নেই ছেলে মেয়ে গুলোর সরকারি চাকরিও জোটেনা৷"গুগল সার্চ করলে সবকিছু চোখের সামনে চলে আসে আর একটা অশ্বত্থ গাছ পাইনা যার নিচে প্রদীপ জ্বালা যায়৷
                 অনু একটা কুর্তি বানাতে দিয়েছিল সেটা দর্জি বেটা এমন বেঢপ বানিয়েছে অনু সকাল বেলা ঐ কুর্তি নিয়ে রওনা হল টেলারের কাছে৷ফুটপাথের উপর দিয়ে হাঁটছে রাস্তার ওপারে দোকান আজ সকাল থেকে ওয়েদারটা একদম ভালো না গুমোট গরম তেমনি রোদ৷অনু আবার ছাতা নিয়ে বেড়তে ভুলে গেছে৷স্কিন ট্যান হবেই আজ৷তেমনি ট্রাফিক জ্যাম চারিদিকে  গাড়ির ধোঁয়া ধূলোয় অসহ্য লাগছে হাঁটতে৷এই অস্বস্তির মধ্যেই অনুর চোখে পড়ল শ্রীলেদার্স শো রুমের উপর সাড়ীর নতুন বুটিক খুলেছে আবার শ্রীলেদার্স ২০%অফ দিচ্ছে৷অনুর মনে হল এবছর চাকরি হলে মাকে বুটিকের সবথেকে দামী সাড়ীটা কিনে দেব৷কাঁধের ওড়নাটা তুলে মুখটা আকাশের দিকে করতেই হঠাৎ একটা অশ্বত্থ পাতা অনুর গায়ে এসে পড়ল৷একি অশ্বত্থ পাতা এখানে৷চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখে ফুটপাথের পাশে একটা বিরাট অশ্বত্থ গাছ তার নিচে ছোট্ট একটা শিব মন্দির৷এতদিন ধরে এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছা কোনও দিন খেয়াল করিনি৷নতুন খাদিমের শোরুম সেনকোর শোরুম বা রেস্টুরেন্ট খুললে আমাদের চোখে ঠিক পড়ে যায় অথচ এতদিন ধরে এই অশ্বত্থ গাছটা অবিরাম অক্সিজেন সরবরাহ করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে তবুও আমাদের নজরে পড়ছে না৷অনু জুতো খুলে অশ্বত্থ গাছের নিচে এসে দাঁড়াল শীতল ছায়ায় শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল৷হাতজোড় করে অনু সংকল্প করল চাকরির জন্য না হোক পরিবেশকে তোমার নিঃশর্ত দানের জন্য আমি একখানা প্রদীপ নিশ্চয় জ্বেলে যাব৷

মনের ব্যথা

           
           দূর থেকে ভেসে আসা অস্পষ্ট সুর ধীরে ধীরে পরিষ্কার ভাবে শ্রুতি গোচরে এল"বালতি...গামলা..."৷রান্না ঘর থেকে লতিকা চেঁচিয়ে বলল"মোম ডাকত বাসনয়ালা কে"৷ছুম ছুম করে নুপুরের তালে ছুটে গিয়ে জানলার শিখ ধরে ফর্সা  টুকটুকে মোম হাকল "এই বালতি গামলা দাঁড়াও মা ডাকছে৷"দরজা খুলে বাসনয়ালার সঙ্গে ব্যস্ত লতিকা এমন সময় পাড়ার মিশ্র মাসিমা বলে উঠলেন" মোম নয় গো মোমের মুতুল কি মিষ্টি কি মিষ্টি" "আর বলবেন না মিশ্রমাসিমা  মিষ্টি না দুষ্টু তারপর দশ বছর বয়স হয়েছে বুদ্ধি হয়নি বলি বোন ছোট আমায় এত জালাস না৷দুজনকে নিয়ে আমি নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি"৷মোম আর মাম্পির দশ বছরের তফাৎ৷মোমের একছত্র রাজত্বে মাম্পির অনুপ্রবেশ মোমের মোটেই ভালো লাগেনা"বাবা এত জামা এত পুতুল সব আমার জন্য এনেছ তো"এই বলে মোম ছুট্টে গিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরল৷মোমের বাবা সুরেশ নাগ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার৷সুরেশ মোমের কপালে চুমু খেয়ে মোম কে কোলে তুলে বলল"তোমারও আছে কিন্তু তুমি তো বড় হয়ে গেছ মা কাল বনুর প্রথম জন্ম দিন৷"
            সকাল থেকে প্রচুর লোকজনের আগমন বড় কেক এসেছে মোম ছুট্টে গিয়ে দিদার কোলে বসল"দিদা মাম্পির জন্য এত গুলো জামা কেন এনেছ"৷স্থুলকায় স্নেহময়ী মোমের দিদা সস্নেহে মোমের গালে স্পর্শ করে বললেন"বনু তো খুব  ছোট হিসু করে জামা ভিজিয়ে দেয় তাই এত জামা৷"চারিদিকে হৈ চৈ সবাই ছোট্ট মাম্পিকে নিয়ে ব্যাস্ত৷লতিকা মোমের হাত ধরে সকলের কাছে নিয়ে আসে "দেখ দেখ এত বড় মেয়ে জামাটাকে কিভাবে ভিজিয়েছে বলে নাকি toilet করতে গিয়ে ভিজে গেছে"এই কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে৷ছুটির দিনের এক অলস সন্ধ্যে বেলায় মোম বাবার কোলে বসে আছে হঠাৎ আবদার করল "বাবা মনে আছে আমি যখন ছোট ছিলাম তখন তুমি কিরকম ঘোরা হতে"৷সুরেশ আনন্দের সঙ্গে বলে উঠল"যাও যাও বনুকে আজ আমার পিঠে বসিয়ে দাও খুব মজা  পাবে মাম্পি"বাবা আমি ৷তুমি বড় হয়ে গেছ মোম ৷সময় এগোতে থাকে তার সঙ্গে সঙ্গে বয়স বৃদ্ধি পায় জীবনেরও পরিবর্তন হয়৷মোমের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল খুব খারাপ হয়েছে৷মোমের বাবা অনেক আশা করেছিলেন  মোমের কাছ থেকে৷ভালো বই প্রতি বিষয়ে মাস্টার মশাই কোনও কিছুর ত্রুটি রাখেননি৷রেজাল্ট হাতে নিয়ে সুরেশ মোম কে বলে"এত খারাপ কি করে হয় মোম তোমার পড়া শোনার কোনও ত্রুটি রাখিনি আমি৷মাম্পি অত ছোট স্কুলের admission test এ first হয়েছে৷বোনের থেকে কিছু শেখে"৷মোম বিদ্রোহী হয়ে বলে ওঠে "মাম্পি মাম্পি আমার সঙ্গে ওর তুলনা করবে না৷মাধ্যমিক ওত সোজা নয়৷"মোম শৈশব থেকে সদ্য যৌবনে পা রেখেছে এই সময় স্বভাবে চেহারায় না না পরিবর্তন আসে ৷মোম ছেলে বেলা থেকেই সুন্দর যুবতী মোমের রূপে সকলেই আকর্ষিত হয়৷সুন্দর করে কাটা চুল নিখুঁত ভাবে শেপ করা নখ৷সাজ পোশাকেও পরিপাটি মোম৷
             কয়েকদিন ধরে মোমের মা খুবই অশান্তিতে ভুগছেন৷সেদিন বাজারে মিশ্র মাসিমা বলেছেন বাড়িতে কেউ না থাকলে একটা ছেলে মোমের সঙ্গে দেখা করতে আসে৷যদিও মিশ্র মাসিমা কে উনি বলেছেন "আমার মোমের উপর পুরো বিশ্বাস আছে৷"কিন্তু তারপর থেকে মোমের উপর কড়া নজর রাখতে শুরু করেছে লতিকা৷মার তার প্রতি কড়াকড়ি আর বোনের জন্য মমতা মোমের কাছে অসহনীয় লাগে৷কোথায় যেন কিছু হারিয়ে যাচ্ছে৷মোম খুঁজতে থাকে তার জীবনের হরিয়ে যাওয়া গুরুত্ব৷বাবা মা র কাছে প্রাধাণ্য আদর বায়না সব৷হঠাৎ করে তুমি বড় হয়ে গেছ এই কথাটা মোটেই ভালো লাগেনা তার বোন ছোট তাই ও আদর খাবে বায়না করবে আর আমি বড় তাই বোঝদার হব এই সমীকরণ মেলাতে পারেনা মোম৷পড়ায় মন নেই উচ্চমাধ্যমিকে দুটো বিষয়ে ফেল করে মোম৷প্রত্যেক নতুন বছরের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বয়স বাড়ে অভিজ্ঞঁতা বাড়ে কিন্তু মোম আজও অনেক পিছিয়ে রয়েগেছে৷
               রাত প্রায় ৮টা তখনও মোম ঘরে ফেরেনি৷লতিকা সুরেশ সর্বত্র খুঁজেও মোমের দেখা পায় নি৷পুলিশে খবর দেওয়া ছাড়া উপায় নেই দেখে দুজনে পুলিশে missing diary করে৷পরের দিন সন্ধ্যে বেলায় পুলিশ সুরেশকে জানায় মোমের সন্ধান পাওয়া গেছে তাকে সঙ্গে যেতে হবে৷তৎক্ষনাৎ সুরেশ পুলিলের জিপে উঠে পরে৷লতিকা  মোমের জন্য অধির অপেক্ষায় বসে থাকে৷পুলিশের জিপ গলি ঘুপচি দিয়ে একটা অন্ধকার গলিতে এসে দাঁড়ায়৷সুরেশের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় এ আমাকে কোথায় আনলেন স্যার৷পুলিশ কর্তা জানায় আপনার মেয়ে এখানেই আছে৷একটা নীচু ছোট দরজায় পুলিশ কড়া নাড়ায় এক মহিলা দরজা খোলে ৷পুলিশ ঘরে ঢোকে সঙ্গে সুরেশ ৷ছোট একটা ঘর হাওয়া বাতাস নেই ৷ঘরের মাঝখানে একটা চৌকি তাতে একটা রং ওঠা চাদর পাতা টিম টিম করছে একটা বাল্ব আর ঐ চৌকির উপর   পুরো ঘর আলো করে বসে আছে মোম৷পুলিশ জানায় আপনার মেয়ে ওনার ছেলে আলতাভ কে বিয়ে মানে নিকা করেছে ওর তো এবছরই আঠারো হয়েছে তাই ও সাবালিকা৷সুরেশ যেন আকাশ থেকে পড়ল সুরেশের চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না৷ দু হাত বাড়িয়ে মোমকে বলে"আয় মা বাড়ি চল  এমন ছেলে মানুষি করতে নেই মা"বলতে বলতে সুরেশের চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে গলা নোনতা লাগে ৷মোমের চোখে মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয়"মোম না আমি এখন রেশমা বাবা আমি তো বড় হয়ে গেছি আমি নিজের ডিসিশন নিজেই নিতে পারি৷"সুরেশ উত্তেজিত হয়ে যায় ঝাপসা করা চোখের জল হঠাৎ শুকিয়ে যায়৷সুরেশ বলে"আজ যদি তুমি আমার সঙ্গে ফিরে না চল মোম তবে কোনও দিন বাড়ি ফিরতে পারবে না আমি তোমায় আর ঐ বাড়িতে ঢুকতে দেব না৷"মোম দৃঢ়তার সঙ্গে বলে"বাড়ি ফিরব বলে তো আলতাভ কে বিয়ে করিনি"৷সুরেশ মেয়ের ঔদ্ধ্যত্ততা সহ্য করতে পারে না সেখান থেকে বাড়ি ফিরে যায়৷
           আলতাভের বিরাট পরিবার ৷মোম আলতাভের বাবা মা কে আব্বা আম্মি বলে ডাকে৷তামাটে গায়ের রং বাদামি চুল কোলে এক শিশু বিছানায় আরেকজন৷এই মেয়ে মোম নয় রেশমা৷দুপুর বেলায় অন্যমনস্ক ভাবে শিশুকে স্তন পান করাচ্ছিল রেশমা শুষ্ক রুক্ষ চুল চোখের কোনে কালি মাঝে মাঝে পেটের কোনায় খুব ব্যথা হয়৷কোমর ব্যথায় একটানা বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা৷জানলার দিকে তাকিয়ে থাকা রেশমার ফ্যকাসে  চোখ  দুটো খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছে৷হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এল"বালতি...গামলা...."সুর করে ভেসে আসা শব্দ গুলো ধীরে ধীরে দূরে কোথাও মিলিয়ে গেল৷

বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

এক দিন রাত্রে

সালটা ১৯৬৪ সেই সময় কোলকাতায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা লেগেছিল৷তখন বাংলা দেশ নিজ অস্তিত্ত্বে আসেনি৷পাকিস্থানে অন্তর্ভুক্ত ছিল৷পাকিস্থানের হিন্দুদের হত্যা করায় ভারতবর্ষে মুখ্যত কোলকাতায় রয়েট লাগে৷যেহেতু ভৌগলিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গ সেই সময়ের পাকিস্থানের  কিছু অংশ যা বর্তমানে বাংলাদেশ তার পাশা পাশি অবস্থান করে সেহেতু  এই রায়টের প্রভাব বঙ্গের মানুষকে প্রত্যক্ষ ভাবে সামনা করতে হয়েছিল৷সাধারণ বাড়ির মানুষজন সবসময় আতঙ্কে দিন কাটাত৷মুসলমানদের আল্লাহ হো আকবর রব শোনা মাত্রই হিন্দুরা তট্স্থ হয়ে যেত আবার বন্দেমাতরম রবে মুসলমানরা আতঙ্কিত হত৷ঘটনা বয়ে গেলেও কিছু কিছু ঘটনা মানুষের মনে নাড়া দিয়ে যায়৷জায়গাটা কোলকাতা থেকে অনেকটাই দূরে ৷আশে পাশে বাড়ি ঘরের সংখ্যা খুবই কম৷একটি বাড়ির বেশ খানিকটা দূরে আরেকটি বাড়ি৷খোলা মাঠ বনজঙ্গলের আধিক্যও বেশী৷কিছু কিছু পাকা বাড়ি তৈরীর কাজ চলছে ৷এই খানেই বাস দেব চৌধুরীর৷দেব বাবু পেশায় সরকারি ড্রাফ্টস ম্যান ছিলেন৷অনেক দিন হল অবসর প্রাপ্ত৷দীর্ঘ্য শীর্ণকায় দেব বাবুর বিশাল পরিবার৷তখনকার দিনে অবশ্য সকলেরই বড় পরিবার হত৷দেব বাবুর ছয় কন্যা ও দুই পুত্র৷কন্যারা সকলেই বিবাহিত৷দুই পুত্র নবীন চৌধুরী ও তারক চৌধুরী ৷নবীনের চেহারা হাট্টা গোট্টা লম্বা চওড়া শ্যাম বর্ণ আর তারক ছিপ ছিপে স্বল্প দৈর্ঘ্য৷তারক ছোটবেলা থেকে খুব ডানপিটে তেমন সাহসী৷দেব বাবুর বড় ছেলে নবীন কোলকাতার এক মিলের হেড ক্লার্ক আর তারক রেলে চাকরি করে৷দু জনেই বিবাহিত তারকের স্ত্রী অন্তসত্ত্বা তাই বর্তমানে উনি বাপের বাড়িতে আছেন৷নবীনের তিন কন্যা তুলী বয়স ৮ গৌরী ৬ আর ননী সবে ৩ মাস৷নবীনের স্ত্রী রমা খুবই সাদা মাটা সারা দিন গৃহ কর্মে যুক্ত৷রমা বেশীর ভাগ সময় ননীকে দেব বাবুর কাছে শুয়ে রেখে নিশ্চিন্ত মনে সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেন৷দেব বাবুর স্ত্রী অর্থাৎ রমার শাশুড়ি সংসারের ঝামেলায় থাকেন না৷ উনি পাড়ায় আড্ডা দিয়ে আর তাস খেলে সময় কাটান৷দেব বাবু তার নাতনীদের প্রাণের বন্ধু৷বয়সের কারণে এখন ভালোভাবে হাঁটা চলা করতে পারেন না বেশীর ভাগ সময় বিছানায় শুয়ে কাটান আর নাতনীদের গল্প শোনান৷তুলী ও গৌরী স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতেই দাদুর কাছে সব অভিযোগ দিনের বৃত্যান্ত নিয়ে বসে পরে৷দেব বাবুর বাড়ির সামনে একটা খোলা মাঠ আছে ঐ খানেই পাড়ার সব ছেলে মেয়েরা খেলা করে৷মাঠ পেরলে এক বিরাট অট্টালিকা৷এই অট্টালিকা এলাকার বিখ্যাত ডাক্তার ডঃব্যাণার্জীর৷আশে পাশের লোকজনকে সতর্ক করা হয়েছে কোন বিপদ দেখলে এই ডাক্তার বাবুর বাড়িতে এসেই জড়ো হতে হবে৷ ডাক্তার বাবু সুরক্ষার নানা ব্যবস্থা করে রেখেছেন আবার ওনার কাছে বন্দুকও আছে৷আল্লাহ হো আকবর ধ্বণিত হলেই সকলে এই খানে এসেই আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় নেবে৷এই খোলা মাঠের কিছু অংশ হরেণ মল্লিক নামে এক ব্যবসায়ী কিনে নিয়েছেন৷হালেই তার বাড়ি তৈরীর কাজ শুরু হয়েছে অনেকটা মাটি খোড়াও হয়েগেছে৷রাত্রেবেলা চারিদিক অন্ধকারই থাকে৷সকলের বাড়িতে electric connention  প্রায়ই আসেনি৷দেব বাবুর নাতনীরা বিকেলে খেলা ধুলা করে এসে যখন পড়তে বসে তখন ঐ পড়ার টেবিলেই বই এর মধ্যে মাথা গুজে ঘুমিয়ে পরে৷ওদের মা পড়ার টেবিল থেকে তুলে নিয়ে ঘুমের মধ্যেই ভাত,ডাল,তরকারি এক সঙ্গে মেখে খাইয়ে দেয় তারপর বিছানায় শুয়ে দেয় ওরা কোনও কিছুই টের পায়না৷তখন বাচ্চাদের জীবনের বেশীর ভাগ সময়টাই খেলা ধূলায় কাটত৷দৌড়া দৌড়ি ঝাপা ঝাপি করে তারা এতটাই ক্লান্ত হয়ে পরত যে সন্ধ্যে হতে না হতেই ঘুমে তাদের চোখ টেনে ধরত৷রাত ৮ র মধ্যে সকলেই গভীর নিদ্রায়৷ঘুমের ঘোরে যাতে বিছানা ভিজিয়ে না দেয় সেইজন্য রমা নিত্যই রাত ১০টা নাগাদ তাদের বাথ রুমে নিয়ে যেতেন৷তারাও ঘুমের মধ্যে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে আবার নির্বিঘ্নে বিছানায় শুয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে পরত৷নবীন আর তারকের বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত সারে নয়টা দশটা হয়৷রমা শশুর শাশুড়ি কে ৯টার মধ্যে রাতের খাবার দিয়ে দেয় ৷তারপর স্বামী আর দেওর এলে তাদের গরম গরম রুটি সেঁকে দেয় তাই রাত অবধি ঊননে আঁচ ধরিয়ে রাখতে হয় ৷সব কাজ মিটিয়ে শুতে শুতে রাত ১১টা হয়৷এভাবেই এদের দিন যাপন হয়৷একদিন রাত ১০টা নাগাদ হঠাৎই আল্লাহ হো আকবর চিৎকার শোনা যায়৷হঠাৎ এমন চাৎকার যেন একদল মুসলমান বলপূর্বক এই এলাকায় অনুপ্রবেশ করে ফেলেছে৷ রাতের বেলায় সকলের শীথিল হয়ে যাওয়া স্নায়ু হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে যায়৷ভয়ে আতঙ্কে কে কি করবে দিশা পায়না৷ নবীন তাড়া হুড়ো করে দুই মেয়ে তুলী আর গৌরীর হাত ধরে টেনে তোলে৷বলে"তাড়াতাড়ি  ওঠ সামনে বিশাল বিপদ৷"এই বলে তাদের হাত ধরে টানতে টানতে ঘর থেকে বার করে আনে৷ এমন অবস্থায় যে করেই হোক ডঃ ব্যাণার্জীর বাড়ি পৌছতেই হবে৷কিন্তু রোজকার নিয়ম মাফিক তুলী ও গৌরী মনে করে নিশ্চয় তাদের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছে৷তাই তারা দুজনেই উঠানে বসে পরে৷নবীন হতবম্ভ হয়ে বলে"সামনে এমন বিপদ আর তোরা প্রস্রাব করছিস৷এদের এই প্রকৃতির ডাক শেষ হতে হতে মুসলমানরা আমায় না শেষ করে দেয়৷"তারপর নিদ্রাচ্ছন্ন দুই মেয়ের হাত ধরে টানতে টানতে দৌড় দেয় ডাক্তার বাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে৷তারক আগেই তার মা ও বৌদি কে নিয়ে রওনা হয়েছে আর নবীনের দায়িত্বে পরেছে তার নিদ্রাচ্ছন্ন দুই কন্যা৷চারিদিকে হই হই সকলেই যে যার বাড়ি থেকে যে যেমন অবস্থায় ছিল ডঃ ব্যাণার্জীর বাড়ির পথে দৌড়াচ্ছে৷নবীন ভয়ে আতঙ্কে দৌড়াতে দৌড়াতে হরেণ মল্লিকের জমির গর্তে পরে কুপকাত৷নিদ্রাচ্ছন্ন তুলী আর গৌরীর এতক্ষণে ঘুমের ঘোর কাটে একে অপরের দিকে চেয়ে বলে"আমরা কোথায়"৷নবীন ব্যাথায় চেঁচিয়ে ওঠে গর্তে পড়ে তার বাঁ পা মোচকে গেছে৷বিপদ সামনে এলে শরীরে এক আশ্চর্য শক্তি চলে আসে তাই কোনও রকমে ঐ গর্ত থেকে উঠে খোড়াতে খোড়াতে দুই মেয়ের হাত ধরে ডাক্তার বাবুর বাড়ি পৌছায়৷ডঃব্যাণার্জীর বাড়ি তখন একটা ছোট খাটো রিফিউজি ক্যাম্প৷ছোট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ সকলের নানা বক্তব্য আলোচনা৷নবীনকে দেখে মনে হচ্ছে উনি তো বেশ কয়েক জনের সঙ্গে হাতাহাতি করে এত দূর এসেছেন৷চুল উস্কো খুস্কো পাঞ্জাবীতে মাটির দাগ বাঁ পা ফুলে উঠেছে৷রমা দেবী ছুটে এসে বললেন"কি হল একি অবস্থা তোমার"৷ডঃব্যাণার্জীর যুবতি কন্যা শকুন্তলা খুবই তৎপর সে দ্রুত মলম নিয়ে এসে নবীনের পায়ে লাগিয়ে দেয়৷এরই মধ্যে সব মেয়েদের চিৎকার শুনে শকুন্তলা ছুটে যায়৷হল ঘরে গিয়ে দেখে হল ঘরের এক কোনায় সব মেয়েরা জড়ো হয়েছে কেউ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে কেউ চোখ বন্ধ করে কেউ হেসে গড়াচ্ছে৷তার ঠিক উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে বছর ১৩কি ১৪র এক কিশোর৷সেও ঐ পাড়ারই বাসিন্দা নাম তার ডিব্বা৷কিন্তু ডিব্বাকে দেখে এই চিৎকারের কারণ ডিব্বা সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় জড় সড় হয়ে দাঁড়িয়ে৷ঐ বিছানা ভেজাবার ভয়ে ডিব্বার মা তাকে জামা কাপড় ছাড়া ঘুমানোর অভ্যেস করিয়েছেন৷তাই এই দুরবস্থা৷মুসলমানদের আতঙ্কে সেও গায়ে কিছু না দিয়ে,যেই অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় চলে আসে৷শকুন্তলা চোখের পলকে একটা বিছানার চাদর এনে ডিব্বার দিকে ছুড়ে ডিব্বার লজ্জা নিবারণ করে৷এই সব হৈ হট্টোগোলের মধ্যে রমা ননীর খোজ করে"ননী ননী কোথায় ওকে তো আনা হয়নি ও তো বাবার কাছে রয়ে গেছে"৷এই বলে রমা কান্নায় ভেঙে পড়ে৷কি করা যায় নবীনের পায়ের যা অবস্থা সে তো কোনও ভাবেই এতটা পথ যেতে পরবে না৷তখন দুর্দান্ত সাহসী তারক বলে"আমি যাব,আমি গিয়ে ননীকে নিয়ে আসব"৷তুলী গৌরী অঝোর নয়ণে কাকার কাছে বিনীত অনুরোধ করে"কাকা ননীকে যখন আনবে তখন দাদুকেও নিয়ে এস"৷সবাই মিলে তুলী আর গৌরীকে বোঝায় দাদুর বরস হয়েছে উনি এতটা পথ পায়ে হেঁটে কোনও মতেই আসতে পারবেন না৷তারক বাড়ি ফিরে যায়৷চারিদিক নিঃঝুম চুপ চাপ৷শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকার আওয়াজ৷রাস্তা ঘাট ঘুটঘুটে অন্ধকার৷বাড়ি পৌছে তারক সিঁড়ির তলায় জড়ো করে রাখা নানা কাজের অকাজের জিনিসের মধ্যে থেকে আত্মরক্ষার জন্য একটা সাবল বেছে নেয়৷তারপর নিজের ঘরে ঢুকে আলমারি খুলে বিয়ের স্যুট আর নতুন কেনা রেডিওটা একটা ব্যাগে পুরে নেয়৷এই চরম আতঙ্কের মুহুর্তেও সে বিয়েতে পাওয়া স্যুট আর সখের রেডিওটার মোহ ছাড়তে পারেনা৷তারপর দেব বাবুর ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত দেববাবুর পাশে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত ননীকে কোলে তুলে নেয়৷আজ তারক প্রায় দশভুজা অস্ত্র সজ্জিত এক হাতে স্যুট ও রেডিওর ব্যাগ আর কোলে ননী৷এমন ব্যতিক্রমী প্রস্তুতি তো সয়ং মা দূর্গাও নেননি৷জিনিসের মায়া যেমন ত্যাগ করতে পারেনি তেমন ভাইঝিকেও ভুলে যায়নি৷এদিকে ডাক্তার বাবুর বিশাল ছাদে সারি সারি থান ইঁট ও কাঁচের বোতল সাজানো রয়েছে যাতে দূর থেকে আক্রমণকারীদের দেখলে ঐ গুলো ছুড়ে  মেরে আক্রমণকারীদের আটকানো যায়৷এরই মধ্যে অস্ত্র সুস্বজ্জিত তারক ননীকে কোলে নিয়ে ডাক্তার বাবুর বাড়ি এসে পৌছায়৷ঐ রাতটা এঅভাবেই কেটে গেল কোনও মুসলমান আক্রমণকারীর ছায়াও দেখা গেল না৷পরের দিন সকালে জানা গেল দু তিনটে মাইক লাগিয়ে বেশ কয়েক জন মিলে আল্লাহ হো আকবর চেঁচিয়ে ছিল যাতে সব হিন্দুরা ভয় পেয়ে যায়৷তুলী গৌরী খুব ভয় পেয়েছিল তাদের প্রিয় দাদুকে মুসলমানরা হয়ত মেরে ফেলবে৷দাদুকে পেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে গৌরী বলে"জান দাদু কাল মুসলমানরা এসেছিল আমরা সবাই ডাক্তার বাবুর বাড়ি চলে গিয়েছিলাম তুমি তো কিছুই জাননা তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে৷তুলি আর আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম,দাদু আমরা তোমার জন্য খুব কেঁদেছি৷"দেব বাবু নাতনীদের বললেন" না গো দিদি আমি তো ঘুমের ভান করে চুপ করে শুয়ে ছিলাম আমি তো বুড়ো হয়েছি আজই মরি কি কাল তাই মুসলমানরা মেরে ফেললেই কি যায় আসে৷"এই হট্টগোলে সবাই যে যার চিন্তা করেছে নিজের প্রাণের,সম্পত্তির,প্রিয় জনের কিন্তু বৃদ্ধ দেব বাবুর কথা হয়ত সকলের মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷দেব বাবুর তাতে কোনও নালিশ নেই৷এটাই সত্য ঐ পরিস্থিতিতে সত্যিই দেব বাবু কে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না৷এটাই বাস্তব ঠিক যেমন মৃত্যুটা একটা বাস্তব সত্য৷কিন্তু দেব বাবুর মতো খোলা মনে সবকিছু সরলতার সঙ্গে গ্রহণ করার ক্ষমতা কজনের আছে৷