Translate

বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৭

সম্পর্কের সমীকরণ





           চঞ্চলের আজকের দিনটা ভালোভাবে মনে থাকবে৷জোড়ে অটো চলছে দুপাশ থেকে নাকে মুখে হাওয়া ঢুকছে মনের ভেতরে একটা সন্তোষ বোধ হচ্ছে৷চঞ্চলের বড় দাদা অপরূপের বার কয়েক সম্বন্ধ ঠিক হয়েও ভেঙে গেছে৷অপরূপের বত্রিশ বছর বয়স হয়েছে আত্মীয় পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে কানাঘুষা নানা কথা শোনা যাচ্ছিল৷শেষ পর্যন্ত চঞ্চল তার পিসেমশাইয়ের সঙ্গে বাগুইহাটিতে এসে মেয়ে পছন্দ করে৷তারপর দেখাশোনা সেরে আজ বিয়ের দিন ঠিক করে বাড়ি ফিরছে৷
               চঞ্চল আর অপরূপ তিন বছরের ছোট বড়৷বরাবরই দুই ভাইয়ের ভাব৷অপরূপ ভাইয়ের অত্যাচারে আজ অবধি নতুন শার্ট কিনে  পরতে পারেনি৷নতুন শার্ট কিনলে আগে চঞ্চল পরবে তারপর দাদা৷এই আবদার ভালোও লাগত অপরূপের৷অপরূপ শান্ত স্বভাবের লাজুক প্রকৃতির আর চঞ্চল তার ঠিক উল্টো৷সামনে দাদার বিয়ে ছোট বেলায় তাদের বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তাই বিয়ের সব দায়িত্ব এখন দু ভাইয়েরই৷চঞ্চল বিয়ের কার্ডে নাম লিখছে আর বলছে "মা তুমি একটু সামলে এত উল্টো পাল্টা বক না আগের বার পেতলের পিলসূচ চাইতে গিয়ে একটা সম্বন্ধ কেটে গেছে৷"মাও ক্ষেপে উঠে বলেন—"হ্যারে একা তোদের বড় করলাম এখন তুই আমায় কথা বলা শেখাবি৷"অপরূপ এসে ভাই ও মায়ের মাঝে মধ্যস্থতা করে৷বিয়ের পর চঞ্চল বৌদি সুবর্নাকে সবসময় আগলে রাখে৷ যতই হোক সে সম্পর্কে ছোট দেওর কিন্তু সম্বন্ধ করে তো সেই বলতে গেলে দাদার বিয়ে দিয়েছে তাই তার দায়িত্বও অনেক৷ আবার দাদা বৌদির সঙ্গে বেশীক্ষণ সময় কাটালেও মুশকিল তখন বৌদির উপর রাগ হয়৷চঞ্চল যতই বিজ্ঞঁ হওয়ার চেষ্টা করুকনা কেন ছেলে মানুষি তো তাকে ছাড়ে না৷অপরূপ তা বোঝে তাই বেশীর ভাগ জায়গায় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে যায়৷কয়েক বছরের মধ্যে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানও আসে ওদের পরিবারে৷ভাইঝিকে পেয়ে চঞ্চলের আননন্দের সীমা থাকে না অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ছোট মুন্নীকে নিয়ে খেলায় ব্যাস্ত হয়ে পরে৷মুন্নীর জন্য ক্লিপ,সুন্দর সুন্দর ফ্রক,খেলনা সব চঞ্চল নিজে হাতে কেনে৷
       অন্নপ্রাশনের দিন বাড়িতে লোকজনের ভিড় তারপর নানান ছোটখাটো নিয়ম কানুন পালন করতে হচ্ছে৷মুন্নী সকাল থেকে কান্না জুড়েছে মাসি, মামা ,দাদু কেউ সামলাতে পারে না৷চঞ্চল ছুটে এসে বলল "আমায় দাও ও আমায় চেনে ৷"মুন্নী তো কাকাকে দেখে ঝাঁপিয়ে চলে গেল৷চঞ্চল গর্বে বুক ফুলিয়ে মুন্নীকে কোলে নিয়ে বেশ দুলকি চালে প্রস্থান করল ৷সবাই বলাবলি করল"ও  চঞ্চল তোর বৌতো খুব ভাগ্যবতী হবেরে কি সুন্দর বাচ্চা সামলাতে পারিস"৷চঞ্চলের জেঠিমা বলল"এবার এই ছোড়াটার বিয়ের ব্যবস্থা কর ৷"তারপর সব মহিলারা উলুধ্বনী দিতে লাগলেন৷
           কয়েক বছরে চঞ্চলেরও বিয়ে হয়ে যায় ৷মুন্নীর বছর তিনেক বয়স সেই অধিকারের ব্যাপার কাকার উপর কাকিমার অধিকার ছোট হলেও এব্যাপারে মুন্নী সজাগ৷কাকিমার উপর মাঝে মাঝে রাগ হয় কাকিমা বকলে মিছিমিছি কাঁদে পাছে কাকা এসে কাকিমাকে বকে৷চঞ্চলের ট্যুরের চাকরি মাঝে মধ্যেই অফিসের কাজে ট্যুরে যেতে হয়৷সেই কাজের জন্যই শিলিগুড়ি যায় সেখান থেকে সবার জন্য জিনিস নিয়ে আসে নিজে হাতে প্যাকেট খুলে সব জিনিস দেখাচ্ছে এমন সময় চঞ্চলের স্ত্রী শতরূপা বলে ওঠে "ঐ গোলাপি ছাতাটা আমার"সঙ্গে সঙ্গে মুন্নী বলে"না আমার"৷মুন্নীর কথায় সবাই হো হো করে হেসে ওঠে৷'আমার আমার'বলে মুন্নীকে কোলে তুলে চঞ্চল গোল হয়ে ঘুরতে থাকে৷বিয়ে হলেও মুন্নীর প্রতি চঞ্চলের ভালোবাসায় ভাটা পড়েনি৷ বর্ষার এক সকালে চারিদিকে বৃষ্টিভেজা ৷সকাল থেকে বৃষ্টি কাজের লোক আসেনি সুবর্না বাসন মাজছে শতরূপা বাটিতে দুধ রুটি নিয়ে খাওয়াচ্ছে৷মুন্নী শতরূপার পেটে হাত দিয়ে বলল" এতে কি আছে কাম্মা"৷শতরূপা মুন্নীর মুখে চামচ তুলে বলল"তোমার ভাই আছে"৷সুবর্না কলের গতি কমিয়ে বলল"কেন বোনও হতে পারে"৷
—"কেন দিদি তোমার মেয়ে বলে কি আমারও মেয়ে হবে নাকি৷"দুই জায়ে মাঝে মধ্যেই অধিকার আর শ্রেষ্ঠ্যতের ঠান্ডা লড়াই চলে যা স্বাভাবিকও বটে৷মাঝরাতে শতরূপার লেবার পেন ওঠে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়৷সকাল বেলা চারিদিক রোদ ঝলমল পরিষ্কার আকাশ কয়েকদিন পর শতরূপা ছেলে কোলে ঘরে ঢোকে৷চঞ্চল মোবাইলে ভিডিও করে ছেলের গৃহ প্রবেশ রেকর্ড করে৷উলুধ্বনি ফুল ছড়িয়ে চঞ্চলের পুত্রের গৃহ প্রবেশ হয়৷বাড়িতে আয়া রাখা হয়েছে মুন্নী ছুট্টে গিয়ে ছোট ভাইকে ধরতে গেলে আয়া চোখ বড় করে বলে "তুমি হাত ধুয়েছ যাও এখন ধরবেনা"৷অপরূপ খবরের কাগজ ফেলে ছুট্টে মুন্নীকে কোলে তুলে নেয়৷যে মুন্নীর সঙ্গে  কেউ উঁচু গলায় কথা বলে না সবসময় তোলা তোলা করে রাখা হয় তাকে চোখ রাঙাবে আয়া? এব্যাপারটা অপরূপের মোটেই সহ্য হয়না৷
            নদীর বেগের মত সময়ও অতিবাহিত হয় গতি আসে চঞ্চল -অপরূপের সংসারেও৷ মুন্নী আর গুবলুও একটু বড় হয়েছ৷মুন্নীর জেদ বায়নাও দিনে দিনে বেড়েছে স্কুল থেকে ফিরে মুন্নী ব্যগ ওয়াটার বোতল ছুড়ে ফেলে টিভির সামনে বসে পড়ে৷দিদিকে দেখে ছোট্ট গুবলু পাশে এসে বসে পড়ে৷দুজনে কার্টুন দেখতে মগ্ন৷চঞ্চল দেখতে পেয়ে ছুটে এসে টিভি বন্ধ করে বলে "খালি টিভি নিজের চোখ খারাপ করবি সঙ্গে ভাইটারও"৷সুবর্নার দেওরের আচরণ ভালোলাগেনা তা বিরক্ত প্রকাশের মধ্যে বুঝিয়ে দেয়৷ মুন্নীও উচ্চ স্বরে কাঁদতে শুরু করে৷ছোট্ট ঘটনা অহেতুক অসন্তোষের কারণ হয়৷এদিকে  মুন্নীর স্কুলের পরীক্ষার রেজাল্ট বেড়িয়েছে বেশীর ভাগ বিষয়েই সে  'C'পেয়েছে৷ অপরূপ আর সুবর্না খুবই চিন্তিত ক্লাস টুতে পড়ে যদি এখনই  এত খারাপ হয় তবে উঁচু ক্লাসে কি করবে৷সুবর্না অপরূপকে বলল "আমি বুঝতে পারিনা ওর কোথায় অসুবিধা পড়ার সময় তো সব বোঝে৷"শতরূপা আটা মাখছিল৷আটা মাখতে মাখতে এসে বলল"দিদি আমার মনে হয় ক্লাসে লাস্ট বেঞ্চের বাচ্চা গুলো থাকেনা কিছু পড়া বোঝেনা কিন্তু ভয়ে জিজ্ঞাস করে না তারপর পরীক্ষায় ফেল করে৷ মনে হয় মুন্নীরও সেরকম কিছু অসুবিধা হচ্ছে"৷চঞ্চলও আলোচনায় যোগ দিল "হুম ,শতরূপা চাইল্ড সাইকোলজি ভালো বোঝে৷বৌদি ও ঠিকই বলছে৷"রেজাল্ট বিভ্রাট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শেও কোনও সমাধান করতে পারে না৷
         মুন্নীর জন্ম দিনের অনুষ্ঠানে সব কচিকাচাদের ভিড়৷অনেক গিফটের প্যাকেট চকোলেটের বাক্স এলোমেলো ভাবে ছড়ান৷গুবলু এক একটা গিফট দেখছে চকোলেটের বাক্স খুলে দু একটা মুখেও পুরছে৷এই দেখে অপরূপ সুবর্নাকে ঈশারা করে  সব তুলে রাখতে বলে৷মেয়ের অধিকারে গুবলুর হস্তক্ষেপ বরদাস্ত হয়না অপরূপের৷অপরূপ মেয়ের ব্যাপারে হঠাৎই যেন বেশী সংবেদনশীল বা মেয়ের অধিকার নিয়ে হয়ত একটু বেশী রক্ষণশীল হয়ে ওঠে৷একদিন দুপুরে মুন্নী আর গুবলুর মাঝে টিভির রিমোট নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়৷গুবলু মুন্নীকে ধাক্কা দেয় মুন্নীও ধপাস করে পড়ে যায় ৷অপরূপ হঠাৎ রেগে গুবলুকে ধমক দেয়"বড় সাহস হয়েছে তোমার এত বড় দিদিকে মারছ"৷সঙ্গে সঙ্গে গুবলুও কান্না জোড়ে রিমোট যুদ্ধ ছোটখাটো তান্ডবের রূপ নেয়৷এই ভাবেই চলতে থাকে সকলের জীবন৷অপরূপ আর চঞ্চলের মধ্যের ভালোবাসা কোথাও যেন ভাগ হয়ে যায় হয়ত ভাগ হয়ে যায় ওদের সন্তানদের মধ্যে৷
        সুবর্না ছোট থেকে ভালো কবিতা বলত বিয়ের পর সেইসব চর্চা চলে গেছে তাই সেই সখ পূরণের জন্য মুন্নীকে কবিতার ক্লাসে ভর্তি করে দেয়৷শতরূপাও সময় নষ্ট না করে গুবলুকে গিটার ক্লাসে ভর্তি করে দেয়৷বাড়িতে লোকজন এলে মুন্নী কবিতার বই আর গুবলু গিটার নিয়ে অতিথী দর্শকদের মনোরঞ্জন করে সঙ্গে সঙ্গে চলে সুপ্ত প্রতিদ্বন্দিতা ৷  সামনে পুজো তাই অপরূপ আর সুবর্না পুজোর শপিংএ বেড়িয়েছে৷কলিংবেলের আওয়াজে মুন্নী দরজা খুলে দেখে পাড়ার পুজো কমিটির সভাপতি মনোজ দত্ত৷মনোছ বাবু বললেন "চঞ্চল এবার পাড়ার ছোটদের নিয়ে পুজোর অনুষ্ঠান করব তাই বলতে এলাম৷"
—"হ্যা জেঠু গুবলু paticipate করবে ও ভালো গিটির বাজাতে পারে"৷শতরূপা গুবলুকে বলল"যা বাবু যা গিটারটা নিয়ে আয়"৷গুবলু নাচতে নাচতে গিটার এনে মনোজ দাদুকে শোনাচ্ছে চঞ্চল পাশে দাঁড়িয়ে পেছনে হাত রেখে মনোসংযোগের সঙ্গে ছেলের গিটারের টুং টাং শুনছে শতরূপা মনোজ বাবুর জন্য চায়ের কাপ এগিয়ে উদ্বিগ্ন ভাবে ছেলের দিকে চেয়ে রইল৷মনোজবাবু খুশী হয়ে বলে গেলেন"বাহ্ চঞ্চল তোমার ছেলের তো খুব প্রতিভা ওর নামটা আমি নিয়ে নিলাম এবারের বিজয়া সম্মিলনীতে ওর একটা সোলো পারফরমেন্স থাকবে৷"বাড়ি ফিরে অপরূপ সব শুনে বলে "মুন্নীও তো কবিতা বলতে পারে ওর নামটা দিলি না"৷চঞ্চল বলল"কই মুন্নীতো কিছু বলল না"৷বিজয়া সম্মিলনীতে গুবলু পারফর্ম করল৷অপরূপ সেইদিনই পরিবার নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল সুবর্নার বাড়ি বিজয়া করতে৷
        দিওয়ালীতে বাচ্চারা বাজি পটকা ফাটাচ্ছে৷মুন্নীকে ডেকে পাড়ার অল্প বয়সী মেয়ে নিরূপা বলল "মুন্নী দেখ তোর ভাই সকাল থেকে আমাদের বাড়ির সামনে পটকা ফাটাচ্ছে কিছু বলতে যাব তখন পালিয়ে যাচ্ছে এগুলো কিন্তু ঠিক হচ্ছে না৷"মুন্নী নিরুত্তাপ ভাবে উত্তর দিল "আমার ভাই নয় খুড়তুতো ভাই"৷
                চঞ্চল আর অপরূপের সন্তানদের মাঝে এই 'তুতো'সম্পর্ক  সকলের অলক্ষ্যে তৈরী করেছে একটা অদৃশ্য দেওয়াল৷যার উচ্চতা দিনে দিনে বাড়বে  কিন্তু এই দেওয়াল না যাবে ভাঙা না যাবে পার করা৷

রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৭

বিজয়াদশমী






              মিষ্টির দোকানে বিশাল ভিড় বরুণ ঐ ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে কাঁচের শোকেজের উল্টোদিক থেকে সন্দেশে আঙুল রেখে বলল "এই সন্দেশগুলো ২০ টা আর রাজভোগ ২০ টা দিয়ে দাও৷"প্রচণ্ড গরম ভিড়ের মধ্যে  হাঁসফাস করছে৷আজ বিজয়াদশমী বাড়িতে ঠাকুমাকে বিজয়ার প্রণাম জানাতে আসবে সব আত্মীয়৷এবছর পুজো অনেক আগে হয়েছে৷ভাদ্র মাসের অস্বস্থিকর গরমটা  আশ্বিনের শুরুতে রয়েগেছে৷বর্তমানের গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রভাবে ঋতু বৈচিত্রেরও তারতম্য ঘটেছে৷বরুণের ঠাকুমার প্রায় পঁচাশী বছর বয়স পরিবারে উনই বয়ঃজ্যেষ্ঠ পিসি কাকারা সবাই আসেন বরুণদের বাড়ি ঠাকুমাকে প্রণাম করতে৷পুজোর চারটে দিন বরুনের ভালোই কাটে৷চারটে দিন কেন পুজোর আগে থেকেই পাড়ার পুজোর চাঁদা কালেকশন ঠাকুর আনা,ডেকরেটারদের তদারকি করা এসব ছোট খাটো কাজে পাড়ার বাকি ছেলেদের মত বরুণও যোগ দেয়৷তারপর পুজোর চারদিন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ঘুরে আড্ডা দিয়ে রোল খেয়ে ভালোই আনন্দে কাটে কিন্তু এই বিজয়া দশমী দিনটা বরুণের একদম না পসন্দ৷গ্র্যাজুয়েশনের পর প্রায় তিন বছর ধরে বরুণ বেকার বসে আছে৷এদিক ওদিক চেষ্টা করে কোনও মনপুতঃ চাকরি যোগার করতে পারেনি৷সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে হতাশা ছাড়া হাতে কিছুই আসেনি৷বিজয়ার  দিন বাড়িতে প্রচুর লোকের আগমন হয় প্রত্যেকের হাতে থাকে মিষ্টির প্যাকেট আর চোখে বরুণের প্রতি কৌতুহল৷এই অহেতুক কৌতুহলের কারণ হল বরুণের বেকারত্ব৷বরুণের বেকারত্ব যেন সকলকে তৃপ্তি দেয়৷এই কারণেই বিজয়া পর্ব তার না পসন্দ৷
               বাড়িতে ঢুকেই সিঁড়ির তলায় জুতো স্যণ্ডেল দেখে বরুণ আন্দাজ করে নেয় আত্মীয়দের আগমণ শুরু হয়েগেছে৷সিঁড়িতে উঠতে উঠতে ক্রমশঃ ভিন্ন ভিন্ন গলার স্বর স্পষ্ট হতে থাকে৷বরুণ মনে মনে বলল "বেহালার পিসি পিসে এসে গেছে"৷ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই এক মহিলা কন্ঠ স্বর ভেসে এল " কি রে বুড়ো কোথায় ছিলি এতক্ষণ"বরুণ একটু হেসে প্রণাম করে বলল"পিসি কেমন আছো?"
—"ভালো বস আমার পাশে"৷বরুণ বসল৷বরুণের পিসেমশাই অজিত সরকার কর্পোরেশনে উচ্চপদে কাজ করেন৷গোলগাল শ্যাম বর্ণের অজিত বাবু বরুণের পিঠ চাপড়ে জিজ্ঞাস করলেন "কি young manএখন কি করা হচ্ছে"৷এই প্রশ্নটা বরুণের কাছে সবথেকে বিরক্তকর৷বরুণ আশ্চর্য হয় সবাই জেনে শুনে কেন বার বার ওর বেকারত্বের ঘায়ে খোঁচা দেয় তারপর যখন নিশ্চিন্ত হয় যে বরুণ এখনও অবধি কিছু করে উঠতে পারেনি তখন পরম তৃপ্তি পায়৷বরুণ বলল "না সেরকম কিছুই না চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছি৷"এরপর অজিত বাবু বলতে থাকেন "না  না পরীক্ষা দিলেই হবে না যেখানে কাজ পাও ঢুকে পর ৷আগে ঢুকে পড়তে হবে৷অভিজ্ঞতা৷অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে৷বরুণ খানিকক্ষণ চুপ করে বিনামূল্যের পরামর্শ গ্রহণ করার পর উঠে যায়৷বাড়িতে হৈ চৈ হাসা হাসি চলছে৷বরুণদের দোতলা বাড়ি বাড়িটা ঠাকুরদার করা পুরনো দিনের বাড়ি চওড়া দেওয়াল উঁচু ছাদ ৷সামনের দিকের ঝুলন্ত বারন্দায় এসে দাঁড়াল বরুণ৷ঘরের মধ্যে বড্ড দম বন্ধ লাগছিল৷বরুণদের একতলায় ভাড়া থাকেন বসু পরিবার ৷বসুবাবু এক প্রাইভেট কোম্পানীর ইনসিওরেন্স এজেন্ট৷বসুবাবুর ছেলে ব্যাঙ্গালোরে অঙ্কে মাস্টার্স করছে৷যতক্ষণ পড়ছে যতক্ষণ engaged ততক্ষণ লোকে প্রশ্ন করে না প্রশ্ন শুরু হয় পড়া শেষ করার পর বা রেজাল্ট খারাপ হওয়ার পর৷গেটের সামনে আলো এসে পড়ল বরুণ একটু ঝুঁকে দেখল দিদি জামাইবাবু বাইকে করে হাজির৷
                  বরুণ আবার ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়াল ততক্ষণে বালিগঞ্জের বড় পিসি সল্টলেকের ছোট কাকা মেজ কাকা সবাই এক জায়গায় হয়ে গল্পের আসর ভালো জমে উঠেছে৷বরুণ চুপচাপ বসে মোবাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে লাগল৷বরুণের বাবা সরকারি চাকরি করেন আর্থিক অবস্থা মন্দ নয়৷বরুণের মা আর তাদের রাঁধুনী মিলে লুচি ভেজে সকলকে দিচ্ছে পিসি কাকিমারাও হাতে হাতে সাহায্য করছে৷চার বছরের বাবলু বরুণের কাছে গিয়ে বায়না করতে লাগল"মামা মোবাইল দাও গেম খেলব"৷বরুণ বাবলুকে চোখ রাঙাতেই বাবলু চিৎকার শুরু করে "ও কি চাইছে দিয়ে দে না বরুণ" এই বলে মেজ কাকা এগিয়ে এসে বাবলুকে কোলে তুলে নেয়৷খেতে বসে বরুণের ছোটকাকা বলল " বৌদি তোমার হাতের ছোলার ডাল আর ফুলকপির ঝোল এর তুলনা নেই ৷রমা তোমার ধারেকাছে আসতে পারবে না"৷রমা মানে বরুণের ছোট কাকিমা বলে উঠল "বাড়িতে তো দিব্যি চেটে পুটে খেয়ে নাও"৷বরুণের পাতে একটা লুচি দিয়ে বলল "বুড়ো ভালো করে খা,এখনই তো খাবি ইয়ং ছেলে৷তা এখন কি করছিস বাবা"৷বরুণ চুপ করে রইল৷বরুণের মা রান্নাঘর থেকে এসে বললেন "ও সরকারি চাকরির পরীক্ষা গুলো দিচ্ছে"৷
—"ও ভালো আমার দিদির ছেলে রাজু এই তো বরুণের বয়সী খুব চালাক ছেলে একটা বছরও নষ্ট করেনি এখন দিল্লীতে চাকরি করছে৷সামনের বছর দিদি বলছিল ওর বিয়ে দিয়ে একদম সেটেল করে দেবে"৷বরুণের মা একটা হতাশার সুরে বলল"আমার বরুণটার যে কবে গতি হবে"৷
—"চিন্তা করোনা দিদি সবাই তো সমান নয় ওরও হবে"৷বাবলুকে কোলে করে মেজ কাকা একটা চেয়ার টেনে বসল গম্ভীর সুরে বলল "দাদা বারান্দার দেওয়ালে ড্যাম্প ধরেছে তারপর কয়েকটা জায়গায় ফাটল দেখলাম"৷বরুণের বাবা ভাইদের মধ্যে বড় ধীর স্থির স্বভাবের বলল "হ্যা তাতো হবেই পুরোন বাড়ি"৷ছোটকাকা বেসিনের কলে হাত ধুতে ধুতে বলল"এখন কেউ পুরোন বাড়ি নিয়ে বসে থাকেনা দাদা৷প্রমোটারকে দিয়ে দাও তার আগে ভাড়াটে ওঠাবার ব্যবস্থা কর"৷বরুণের বাবা কিঞ্চিত চিন্তিত হয়ে বলল—"বাবার স্মৃতী এত বড় বাড়ি কয়েকটা ফাঁটলের জন্য প্রমোটারকে দেব৷সে তো সবাই মিলে সারাই করলেই হয়"৷
—"সবাই না,আমি নেই"৷এই বলে মেজকাকা লাফিয়ে উঠল৷"এই পুরনো বাড়িতে হাত দিতে গেলে অনেক খরচ আমি এখন টাকা বেড় করতে পারব না৷মেয়ে ম্যানেজমেন্ট পড়ছে তার জন্য ব্যঙ্ক থেকে লোন নিয়েছি"৷বাড়ি নিয়ে বাগবিতণ্ডা চলতে থাকে৷
            রাতে যে যার বাড়ি ফিরবে৷বরুণের ঠাকুমাকে নমস্কার করে একে একে সব বিদায় জানায়৷ছোটকাকা বরুণের ঠাকুমার চরণ স্পর্শ করে বলল "মা আজ আসছি ভালো থেকো"৷পঁচাশী বছরের বৃদ্ধা কম্পিত হস্তে ছেলের চিবুক ধরে ফ্যাকাসে দৃষ্টিতে বলল"আমি তো অনেক পুরোন হয়ে গেছি আমাকে কার কাছে দিবি৷"প্রশ্নটার উত্তর সেদিন কারো কাছেই ছিলনা৷
          ঘরের লাইট অফ করে খাটে শুয়ে শুয়ে বরুণ গুগল সার্চ করছে চাকরির ভ্যাকেন্সি দেখছে৷বাইরে ভালো হাওয়া ছেড়েছে জানলার পর্দা গুলো হাওয়ায় ফুলে উঠছে আবার হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জানলার গ্রিলে এসে ধাক্কা খাচ্ছে৷বরুণের মা বরুণের পাশে এসে বসল৷বরুণ মোবাইল পাশে রেখে মায়ের কোলে মাথা রাখল৷মায়ের ঠান্ডা আঙুল গুলো বরুণের চুল এলেমেলো করে দিল৷সারা দিনের কথায় প্রশ্নের আঘাতে ভারাক্রান্ত মাথাটা যেন পরম শান্তি পেল৷

বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৭

আলু কাবলী

           




                  রাস্তার উপর সারি সারি ছোট বড় দোকানের মাঝে সাদা সবুজ রঙ দিয়ে লেখা"নিরোগ প্যাথলজি সেন্টার" ৷এই প্যাথলজি ল্যাবেই কাজ করে অচিন্ত বর্মন৷ব্যস্ত রাস্তার উপর ল্যাব ৷আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে বেশীর ভাগ পরীক্ষা নিরীক্ষা অনত্র করাতে হয়৷সাধারণ রক্ত পরীক্ষা যেমন হিমোগ্লোবিন,টি.সি.ডি.সি,ই.এস.আর,ব্লাড সুগার,সোয়াপ,স্টুল,ইউরিন টেস্ট ইত্যাদি গুলো এখানেই হয়৷অন্য প্যাথলজির তুলনায় এই ল্যাবে ভিড়ও কম৷তবে সকালের দিকে ভালোই ভিড় হয় আর বিকেল পাঁচটা ছটা নাগাদ লোকে রিপোর্ট নিতে আসে৷অলস দুপুর অচিন্তের ঝিমিয়েই কাটে৷ল্যাবের সামনে একটা ফুচকায়ালা বসে৷ল্যাবের থেকে ফুচকার ঠেলায় ভিড় বেশী হয়৷অচিন্ত মাঝে মধ্যে  দাঁড়িয়ে পরে শাল পাতা হাতে নিয়ে ৷বেশ  কয়েক দিন হল অচিন্তর  ফুচকা আলুকাবলী খাওয়া হয় না৷বর্ষার সময় জল ভালো থাকেনা নানা জীবাণুর সংখ্যা বাড়ে তাই ঐ বর্ষার সময়টা শত ইচ্ছে হলেও অচিন্ত ঠেলার ছায়া মাড়ায় না৷বর্ষা পেরিয়ে শরৎ এর আগমন হয়েছে৷আকাশ বাতাসে শরৎএর হাওয়া৷কদিন ধরে  অচিন্তর মন চাইছে একটু আলুকাবলী খেতে৷কদিন ধরে কাজের চাপটাও বেড়েছে সময় বেড় করতে পারছে না৷একদিন বিকেল বেলায় এক পা দু পা করে হাঁটতে হঁটতে ঠেলার কাছে আসতে দেখে দুজন তরুনী অচিন্তকে দেখে একেঅপরের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে তাদের হাতের শালপাতার তলা দিয়ে তেঁতুল জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে৷অচিন্তকে এই এলাকার সকলে 'প্যাথোলজির লোকটা' হিসাবে চেনে৷তাই অচিন্তর কেমন একটু লজ্জা করল সে আবার ল্যাবে ফিরে গেল৷আজও তার আলুকাবলী খাওয়া হল না৷পরের দিন সকাল থেকে ল্যাবে খুব একটা ভিড় নেই ৷অচিন্ত আজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আজ ঠেলার সামনে যেই থাকুক আজ সে আলুকাবলী খেয়েই ছাড়বে৷ল্যাবে বসে সামনের রাস্তায় চোখ পড়তেই দেখে ফুচকায়ালা সেদ্ধ আলু গোল গোল করে কাটে তারমধ্যে লঙ্কা গুড়ো ,বিটনুন,তেঁতুল জল দিয়ে ভালো করে মেখে শালপাতায় ঠেসে ঠেসে ভরে উপর থেকে কুচনো ধনে পাতা আর লেবুর রস ছড়িয়ে দেয়৷আজ অচিন্তকে কেউ আটকাতে পারবেনা৷টক খেতে অচিন্ত বরাবর ভালোবাসে তারপর বর্ষার জন্য আলুকাবলীর সঙ্গে অনেকদিনের বিরহ আর সহ্য হচ্ছে না৷ভাবতে ভাবতে দেখে এক তন্বী সবুজ রঙের কুর্তি আর সানগ্লাস চোখে তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে৷অচিন্ত জিজ্ঞাসা করল "বলুন"৷তরুনী উত্তর দিল"আপনাদের এখান থেকে কেউ বাড়িতে রক্ত নিতে যায়৷ আমার ঠাকুমা অসুস্থ্য উনি এখানে আসতে পারবেনা"৷এই বলে তরুনী সানগ্লাস খুলতেই অচিন্ত বলল"পারোমিতা না?চিনতে পারছনা"৷তরুনীও হেসে বলল"ওমা অচিন্তদা তুমি"৷অচিন্ত পারোমিতার থেকে দুবছরের সিনিয়ার ওরা একই স্কুলে পড়ত৷অচিন্ত নিজে উদ্যোগ নিয়ে পারোমিতাদের বাড়ি গিয়ে তার ঠাকুমার রক্ত নিয়ে আসে৷রিপোর্ট পৌছেদেয় তারপর মাঝে মধ্যে ফোন করে কথা বলে দুজনে৷অচিন্তর একঘেয়ে জীবনে বসন্তের ছোয়া নিয়ে আসে পারোমিতা৷ল্যাব,সামনের রাস্তা ,ফোনের রিংটোন সবকিছুই হঠাৎ করে রোমান্টিক লাগতে থাকে অচিন্তর কারণ তার হৃদয়ে অনুপ্রবেশ করেছে পারোমিতা৷একদিন বিকেলে পারমিতা অচিন্তর ল্যাবে এসে বলল "কাল ঠাকুমার ইউরিন টেস্ট আছে একটা কন্টেনার দাও৷"অচিন্ত ড্রয়ার থেকে কন্টেনার বের করে পারোমিতার হাতে ধরিয়ে বলল"পারোমিতা আলুকাবলী খাবে?"পারোমিতা হেসে বলল"আলুকাবলী"
—"হ্যা চল না সামনের ফুচকায়ালা ব্যপক বানায় আমি ভীষন ভালোবাসি চল না"৷পারোমিতা একটু ভ্রূ কুঁচকে সামন্য  ইতস্তত  হয়ে বলল"না আমি না, তুমি খাও গো আমার আজ একটু তাড়া আছে৷"
              অচিন্তর একদিন মনে হয় মনের মধ্যে পারোমিতাকে না রেখে একবার বলেইদি যে আমার ওকে ভালোলাগে আর আমি ওর জন্য সিরিয়াস৷ফোন করে পারোমিতাকে বলে "পারোমিতা কেমন আছো"
—"ভালো আছিগো অচিন্তদা"৷
—"তোমার সঙ্গে আজ বিকেলে একটু দরকার ছিল আসতে পারবে?"
—"দেখছি "৷এই বলে পারোমিতা ফোন রাখে৷বিকেলে অচিন্তর ল্যাবে পারোমিতা কথামত আসে৷অচিন্ত বলে —"চল একটু ঘুরে আসি৷"
—"কেন তুমি তো বলেছিলে তোমার দরকার ছিল"৷
—"হ্যা বলছিলাম ,আসলে কদিন ধরে ভাবছিলাম তোমায় বলব পারোমিতা, আমার তোমায় খুব ভালোলাগে আমি তোমাকে....."পারোমিতা অচিন্তর কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই বলল "আমি এখন আসছি"৷অচিন্তর সব বোঝা হয়ে গেল৷পারোমিতার মুখের অভিব্যক্তিতে অচিন্তর মুখ শুকিয়ে গেল৷
                  অন্য ল্যাব থেকে  ব্লাডরিপোর্ট  আনে শেখরদা ৷শেখরদার মেয়ের জ্বর তাই অচিন্ত ঐ রিপোর্ট আনতে বাসে উঠেছে৷খুব একটা ভিড় নেই তাই একটা সিট দেখে বসে পড়ল৷বাস ঘটিবাড়ি স্টপেজে থামতে বাসের গেটে চোখ পড়তে অচিন্ত দেখল পারোমিতা এক বান্ধবীর সঙ্গে বাসে উঠল৷দুজনের চোখিচোখি হতে পারোমিতা চোখ সরিয়ে নিল৷বাস চলছে ফাঁকা বাস তাই বারবার অচিন্তর চোখ পারোমিতার দিকেই যাচ্ছে৷পারোমিতা তার বান্ধবীকে কথা শোনাবার ছলে বলল"জানিস তো অনুষ্কা কিছু ছেলে আছে দেখবি মেয়ে দেখলে হাঁ করে থাকে আর মেয়েদের মত আলুকাবলী ফুচকা খায় আমার এসব ছেলে গুলোকে একদম অসহ্য লাগে"৷এই বলে পরের স্টপেজে ওরা দুজন নেমে গেল৷অচিন্তর ভগ্ন হৃদয়ে আরেকটু আঘাত লাগলেও সে নিজেকে সামলে সেই দিনই একগোছা ব্লাডরিপোর্ট ব্যাগে করে নিয়ে বাস থেকে নেমে সোজা গিয়ে পৌছাল ফুচকায়ালার কাছে৷তখন দুজন মহিলা শালপাতায় চুমুক দিয়ে টক জল খাচ্ছে একজন যুবতী ফাউ এর অপেক্ষায়৷অচিন্ত তাড়িতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বলল"দাও ভাই আমায় ভালো করে আলুকাবলী মেখে দাও"আলুকাবলী হাতে নিয়ে অচিন্তর মনে হল আজ বিরহের দিন শেষ আলুকাবলী, আজ প্রানখুলে আমি তোমার স্বাদ নেব৷পারোমিতার টিপ্পনীর জন্য আমি আলুকাবলীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারব না৷

রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৭

বন্ধন

       

           শীতের রাত সকলের বাড়ির জানলা দরজা বন্ধ৷১৩/বি দেবেন্দ্র নাথ লেন একদম শুনসান৷স্ট্রীট লাইটের তলায় একটা নেড়ি কুকুর চেঁচিয়ে ঠান্ডায় গা গরম করছে৷ঐ কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে আসে পাশের পাড়ার দুতিনটে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না৷পাল বাড়ির ভিতরের পরিবেশটাও আজ নিঃস্তব্ধ৷বসুন্ধরা পাল তার স্বামী প্রকাশকে বলল"হ্যাগো,এমন দিন দেখব বলে কখনও ভাবিনি"৷প্রকাশ একটু হতাশ হয়ে বলল"না..."৷পাশের ঘরে  দরজার সামনে গিয়ে বসুন্ধরা ডাকল"কোয়েল... কোয়েল"৷কোনও উত্তর না পেয়ে ঘরে ঢুকে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে শুয়ে থাকা কোয়েলের  মাথায় হাত বুলিয়ে বলল"খেতে চল আর মুখ ভার করে থাকিস না৷তুই যা চাইছিস তাই করিস৷তোর বাবার আর আমার কোনও আপত্তি নেই৷"গায়ের থেকে কম্বল সরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল কোয়েল৷"সত্যি"৷—"হ্যা বাবা সত্যি এখন খাবে চল৷"
                  ইদানীং বসুন্ধরার কিছুই ভালোলাগেনা৷বসুন্ধরার একটা বুটিক আছে৷বুটিকের কাস্টমাররা বসুন্ধরার মিশুকে ব্যবহারের জন্য তার বাঁধা খোদ্দের হয়ে গেছে৷আজ বসুন্ধরার কোনও কাজে মন নেই৷এক অল্প বয়সী মহিলা কাঁথা স্টিচের উপর বিভিন্ন ডিজাইনার শাড়ি দেখতে চাইলেন৷বসুন্ধরা শাড়ি দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পরে এরই মধ্যে ঐ অল্পবয়সী মহিলার ছোট্ট ছেলে 'মা  মা  'বলে ছুটে ঐ ভদ্রমহিলাকে জড়িয়ে ধরতেই বসুন্ধরার বুকটা কেঁপে ওঠে৷একটা অজানা শক্তি অজান্তেই বসুন্ধরার মনটাকে দূরে উড়িয়ে নিয়ে যায়৷বর্তমান থেকে অনেক পিছিয়ে প্রায় পনেরো বছর আগে৷বসুন্ধরা আর প্রকাশের বিয়ের অনেক গুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও তারা সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিত ছিল৷ডাক্তার দেখাবার পর কিছু ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে প্রায় দিনই যেতে হত৷একদিন অন্যমনস্ক ভাবে হাসপাতালের লিফ্টের ভুল বোতাম টিপে উনি শিশুবিভাগে পৌঁছে যান৷বাচ্চাদের আকর্ষণে ঘুরতে ঘুরতে ভেতরে ঢুকে যান৷অনেক কচিকাচার মধ্যে গোল গাল চাঁপা গায়ের রঙের একটি ছোট্ট মেয়ে"মা...মা"বলে ডেকে বসুন্ধরাকে জড়িয়ে ধরে৷"মা তুমি এসেছ,আমি কবে থেকে তোমার জন্য বসে আছি"৷বসুন্ধরা চোখে জল ধরে রাখতে পারেনা শিশুটিকে কোলে তুলে বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদতে থাকে৷নার্স ছুটে এসে বলে—"আপনি চেনেন ওকে"
—"না সিস্টার কিন্তু ও আমায় মা বলছে যে"৷নার্স জানায় "ওকে ওর বাবা খুব অসুস্থ্য অবস্থায় আমাদের হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়৷প্রথম প্রথম দেখা করতে এসেছে তারপর বেপাত্তা৷আমরা অনেক খোঁজ করেছি কিন্তু ঠিকানা ফোন নাম্বার সব ভুল ছিল"৷বসুন্ধরা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল"তারপর ,তারপর কি হল?"
—"তারপর আরকি এখানকার ডাক্তার বাবুরা আর আমরা নার্সরা সবাই মিলে ওর দেখাশোনা করি৷ও যখন ওর মায়ের কথা জিজ্ঞাস করে তখন বলি একদিন তোমার মা ঠিক তোমায় নিতে আসবে কিন্তু আপনাকে দেখে এমন মা মা কেন করল কে জানে ও কিন্তু এরকম করে না৷"সব শুনে বসুন্ধরা বলল"তাহলে আপনি সব ব্যবস্থা করুন সিস্টার আমি সব আইন কানুন মেনে ওকে দত্তক নিতে চাই৷৷"ঐ হাসপাতাল থেকে চার বছরের ছোট্ট মেয়েকে দত্তক নেয় বসুন্ধরা ৷নাম রাখে কোয়েল৷বসুন্ধরা আর প্রকাশের জীবনে কোয়েল আসার পর ওদের জীবনের কেন্দ্র বিন্দু হয়ে ওঠে৷আর পাঁচ জন মা বাবার মতন তারাও স্নেহ দায়িত্বের সঙ্গে কোয়েলকে মানুষ করে৷মা বাবার স্নেহ মমতায় পুষ্ট কোয়েল আজ জেদ ধরেছে সে তার আসল বাবা মা কে খুঁজে বেড় করবে৷তাই বসুন্ধরার মন এত চঞ্চল আজ৷মনে হয় 'আসল বাবা মা'আমাদের পর করে দিলি কোয়েল৷প্রকাশ প্রথমে রাজি হয়নি কিন্তু মেয়ের জেদের কাছে পরাজিত হয়েছে৷কোয়েলকে সেই হাসপাতালের ঠিকানা দিয়েছে যেখান থেকে তারা ওকে এনেছিল৷কোয়েল যখন বড় হচ্ছিল সব বুঝতে শিখছিল তখনই বসুন্ধরা কোয়েলকে সব বুঝিয়ে ছিল৷বলেছিল কোয়েল ওদের পালিত কন্যা কিন্তু  বসুন্ধরা আর প্রকাশের জীবন কোয়েল ছাড়া অস্পূর্ণ৷তবু আজ কোয়েল তার বায়োলজিকাল প্যারেন্টস দের খুঁজতে চায়৷
                 কোয়েল হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে কোনও হদিস পায় না৷তবু সে তার সন্ধান অভিযান চালিয়ে যায়৷একদিন কাবার্ডের জামা কাপড় গোছাতে গিয়ে একটা প্যাকেট পায় বসুন্ধরা৷প্যাকেট খুলে কোয়েলের ছোট্ট বেলার সুন্দর কুঁচি দেওয়া গোলাপী ফিতের একটা ফ্রক পেল৷ফ্রকটা হাতে নিয়ে আবার অতীতে পাড়ি দিল বসুন্ধরা৷প্রথমবার স্টেজে উঠে এই ফ্রকটা পরে সুকুমার রায়ের 'নোট বই'কবিতাটা বলেছিল কোয়েল৷ভয়ে বার বার আমায় খুঁজছিল ওর চোখ আর আমি স্টেজের পেছন থেকে ওকে সাহস দিয়ে গেছি৷একটা গভীর শ্বাস ফেলে ভাবল তাহলে কোথায় ফাঁকি ছিল আমার যে আজ কোয়েল ওর আসল বাবা মাকে খুঁজতে মরিয়া হয়ে পড়েছে৷পাশের ঘর থেকে কোয়েল আর প্রকাশের মধ্যে কিছু নিয়ে তর্ক হচ্ছে৷প্রকাশের গলার স্বর ক্রমশ চড়ছে—"খবরের কাগজে দিয়ে কি হবে কোয়েল?তুই তো ফেসবুকে তোর ছোটবেলার ছবি হাসপাতালের নাম ঠিকানা সব দিলি কোনও response তো এলনা আবার খবরের কাগজ কেন?"
—"হয়ত ওদের ফেসবুক নেই কিন্তু খবরের কাগজ সবাই পড়ে"৷
—"তাদের ফেসবুক নাই বা থাকুক তাদের বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজন কেউই...."বসুন্ধরা প্রকাশের কথা কেটে বলল"ঠিক আছে ওর যা যা ইচ্ছে হচ্ছে ওকে করতে দাওনা৷"কোয়েল খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে রোজ অপেক্ষায় থাকত যদি কোনও আগন্তুক আসে তার খোঁজে কিন্তু কেউ এলনা৷ধীরে ধীরে কোয়েলের মাথা থেকে আসল বাবা মা খোঁজার ভূত নামল৷একদিন শীতের সকালে কোমল রোদে বসে বসুন্ধরা কোয়েলের মাথায় তেল মাখতে মাখতে বলল"হ্যারে কোয়েল আমাকে কি তুই নিজের মা বলে মানতে পারিস না"
—"কেন মা এ কথা কেন বলছ৷"
—"তবে যে তুই তোর আসল মা খুঁজতে বেড়িয়ে ছিলি৷"
—"অনেক ইচ্ছে হয়েছিল মা,একবার তাদের খুঁজে বের করি আর তাদের তোমার সামনে এনে বলি ভাগ্যিস তারা আমায় ঐ হাসপাতালে ফেলে চলে গিয়েছিল তাই তো আমি তোমায় পেলাম মা৷ওদের বলতে ইচ্ছে হয়েছিল আমায় ফেলে দিয়ে তোমরা আমার উপকারই করেছ৷আমি খুব সুখে আছি৷এই সুখ তোমরা আমায় কোনও দিনও দিতে পারতে না৷"এই বলে মা মেয়ে হেসে উঠল৷রৌদ্রজ্জ্বল শীতের সকাল তাদের হাসিতে আরও ঝলমল করে উঠল৷