Translate

বুধবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৭

নিয়তি

     
        বাজার পেরিয়েই বংশিদের মুদি দোকান। মস্ত বড় দোকান।দোকানে ঢুকতেই ডান পাশে ছিম ছাম চেহারার কমলা সাধু হাতে পেন আর কাগজ নিয়ে খদ্দেরের ফর্দ লিখতে সর্বক্ষণ ব্যস্ত অবস্থায় থাকে। দোকানে ভিড়ও ব্যাপক সব জিনিসের কোয়ালিটি এক নম্বর আবার জিনিস পিছু দামেও ছাড় মেলে। বড় ভাই রসিক সাধুর বয়স হয়েছে সে এক কালে দাপিয়ে দোকানদারি করেছে এখন ক্যাশের দায়িত্বটা নিজের কাছে রেখেছে। দোকানের সামনে বড় বড় চালের বস্তার খোলা মুখে কোয়ালিটি অনুযায়ী দামের লেবেল করা চৌক পিজবোর্ড রাখা। খদ্দেররা অনেকে হাতে চাল তুলে চালের আকার আকৃতি দেখছে অনেকে দাম দেখে আবার হাত ঝেড়ে চাল বস্তায় ফেলে চলে যাচ্ছে। খানিকটা ভিতরে ঢুকতে বস্তায় বস্তায় সারি সারি নানান রকম ডাল টিনের জারে তেল ঘি রাখা ।কর্মচারী ইলেকট্রিক ওজন যন্ত্রে ওজন করে সব জিনিস দিচ্ছে। দোকানের দেওয়ালে শোকেজে প্যাকেটের সব জিনিস ঠাসা। স্বল্প মূল্যের পাউচ প্যাকেট গুলো ঝোলানো রয়েছে। অনেক দিনের দোকান ।বংশী সাধুর বাপের আমলের বংশিও বেঁচে নেই কিন্তু তার নামেই দোকান চলছে। চারজন কর্মচারী আছে তাতেও মাসের প্রথমে মাসকাবারি করতে আসা খদ্দেররা যখন এক সঙ্গে এসে হামলে পড়ে তখন সামাল দিতে গলদঘর্ম হতে হয় সকলকে। কমলা সাধুর একমাত্র ছেলে রমেশ। রসিক সাধুর দুই মেয়ে তাদের বিয়ে হয়েগেছে অনেক বছর। এই দোকানের দায়িত্ব ভবিষ্যতে যার হাতে আসবে সে হল এই রমেশ। কিন্তু বাপ ঠাকুরদা  যে মেহনত করে এই দোকান দাঁড় করিয়েছে তার প্রতি কোনও মোহ মায়া নেই তার। সে তো প্রেমিক স্বভাবের। একান্নবর্তী পরিবারের এক মাত্র ছেলে যখন যা বায়না করে বাপ জ্যাঠা  তা দিয়ে দেয়। কষ্ট করে উপার্জনের সুখ মর্ম সে কিছুই জানেনা সে তো প্রেমিক তার প্রেমের স্বপ্নে উড়তে ভাল লাগে। গেল বছর জন্মদিনে বাপের কাছ থেকে  একটা বাইক আদায় করেছে। রসিক সাধু সেকেলের  মানসিকতার লোক ধমকে কমলাকে বলেছিল " যা মন চায় তাই কর এইভাবে ছেলের  মোহে ফুঁ দিয়ে টাকা ওড়ালে এক সময় কাঙাল হতে হবে। "সেই অতি শখের বাইকে চেপে দোকানে এসে উপস্থিত হল রমেশ। ইদানীং জ্যাঠা তার রকম সকমে বেশ অসন্তুষ্ট। রমেশ জ্যাঠা কে এড়িয়ে বাপের কাছে এসে ফিসফাস করছে। কমলা তার দাদা কে বলল ..."দাদা ওকে কিছু টাকা দাও না।"
..."কেন। ফুর্তি করতে এক পয়সা দেব না। "
..."জ্যাঠু কলেজ ফী। " এই বলে ক্যাশ বাক্সের উপর ঝুঁকে পড়ল রমেশ। দোকান ভর্তি লোক আর কর্মচারীদের সামনে কিছু বলতে না পেরে একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করল রসিক তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে আরেকটা জ্যাঠু বলে দুটো পাঁচশ নিয়ে বাইকে চড়ে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।
             রবিবার মাছের বাজারে নানা রকম মাছ ওঠে আজ আবার রসিকের মেয়ে জামাই আসবে। বাজারের থলি নিয়ে মাছের বাজারে ঢুকল। স্বভাবগত ভাবে হিসেবি রমেশ পাবদা, পার্শে, চিংড়ি যাই দর করে দাম শুনে পিছিয়ে চলে আসে। বাজার এখন কমলা আর রমেশ করে সে আসেনা বহুদিন তাই দাম গুলো যে এত বেড়ে গেছে তা হজম হয় না রসিকের। বড় ট্রে তে জলের মধ্যে চারা মাছ গুলো খাবি খাচ্ছে দামেও পোশায় কিন্তু মেয়ে জামাই আসছে। জামাই এর পাতে চারা মাছ দেয় কি করে। অনেক  দ্বিধায় মাংসের দোকানে লাইনে দিয়ে মুরগী কিনে বাড়ি ফেরে রসিক। কালবৈশাখীর সময় রোজ বিকেল হতেই মেঘে আকাশ কালো হয়ে আসে। চারিদিকে ধুলো উড়িয়ে ঝড় ওঠে। রমেশের বিকেলে ঋতুপর্নার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার প্ল্যান আছে। সেই স্কুলের  সময় থেকে নানা মেয়েদের সঙ্গে  প্রেম করে শেষমেষ এই ঋতুপর্না কে তার প্রেয়সী করে তুলতে চায় সে। মোবাইলে হোয়াটস  অ্যাপে মেসেজ এল..."কখন আসছ।"এপাশ থেকে রমেশ লিখল
..."পাঁচটায় বেরব। "সঙ্গে  সঙ্গে মোবাইল বেজে উঠল রমেশ হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে মিষ্টি কণ্ঠস্বরে ভেসে আসে ..."আগের বার পুরো দশ মিনিট দেরি করেছ এবার তার শাস্তি। "
..."শাস্তি ,এই শাস্তি কেন ওটা ট্রাফিকের জন্য দেরি হয়ে গিয়েছিল ।"
..."তা আমি জানি না তোমায় আগে থেকে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। "
..."জো হুকুম হুজুর। "বলে সশব্দে একটি চুম্বন রমেশ ফোনের এপাশ থেকে তার প্রেয়সীকে পাঠাল। 
          আলমারি খুলে ডেনিমের ব্লু জিন্স আর ঋতুপর্নার প্রিয় হলুদ রঙের টি শার্ট বের করল। বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ট্রিমার দিয়ে দাড়িটা ভলো করে ট্রিম করল তারপর হেয়ার জেল লাগিয়ে ব্যক ব্রাস করে চুল সেট করে নিজেকে নানা দিক থেকে ভালোভাবে দেখতে লাগল।ঋতুপর্না কেন? যখন ও বাইকে করে যাবে তখন যে কটা মেয়ে ফ্ল্যাট হবে সেটাই হল এখন চিন্তার বিষয়। বডি স্প্রে লাগাচ্ছে  এমন সময় রমেশের মা নাকে কাপড় দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল ..."কি সব ঝাঁ জালো গন্ধ গায়ে দিস বাবা এত গন্ধ আমার মাথা ধরে যায়। রোজই জামা কাপড় কাচছি তাতেও এসব দিতে লাগে। রমেশ কোনও গুরুত্ব না দিয়ে নিজের সাজেই মগ্ন।উনি বললেন ..."কোথায় যাচ্ছিস এখন? কি মেঘ করেছে খুব জোড় ঝড় আসবে।"
..."আমার দরকার আছে মা।"
..."কিসের দরকার এমন ঝড়ের মুখে আমি কিছুতেই  তোকে বেরতে দেব না। "
      রমেশ বিপদ দেখে কোনও রকম কথা বার্তায় না জড়িয়ে বাইকের চাবি নিয়ে তীরের বেগে বেরিয়ে গেল। বাড়ি থেকে বেরবার মুখে জ্যাঠার সামনে পরল রসিক চোখ মুখ কুঁচকে বলল..."এখন কোথায় বেরচ্ছিস ঝড়ের মুখে। "রমেশ জ্যাঠা কে এড়িয়ে বেরিয়ে  পড়ল। রসিক আপন মনে চেঁচাতে লাগল ..."এমন ঝড় বাদলের দিন, আমি বাইরে ফুল গাছের টব গুলো সব একধার করে রেখে এলাম,ওমা ঘরে ঢুকতে দেখি বাবু ফুলবাবু হয়ে চললেন ঝড়ের মধ্যে, যত সব। তোমরা বুঝবে আশকারা দিয়ে ছেলেকে মাথায় তুলেছ। "
       রাস্তার উপর বাইক ছুটছে চারিদিক ফাঁকা সামনে কালবৈশাখী তার কালো রূপের গর্বে ফুঁসছে। শুকনো হাওয়ার সঙ্গে রাস্তার ধুলো, শুকনোপাতা,প্লাসটিক আছড়়ে পড়ছে এদিক ওদিক। শুরু হল বৃষ্টি। রমেশ মেন রাস্তা ছেড়ে  গলিতে এসে উঠেছে। সামনে একটা বড় আম গাছের তলায় বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বার বার ঘরি দেখছে আজও সে লেট হয়ে যাবে। ঝতুপর্নাকে সামনের বকুল তলা স্টপেজ থেকে পিক করার কথা ছিল। কিন্তু এত বৃষ্টিতে ও কোথায় দাঁড়িয়েছে কে জানে। হঠাৎ শ্রবণ শক্তি বধির করে আকাশ চীড়ে তীব্র শব্দের সঙ্গে বাজ পড়ল।        দোকানে এক খদ্দের এসে বলছে ..."আগের বার যে চালটা দিলেন এবার সেই একই দামের চাল নিয়ে গেলাম কিন্তু অনেক তফাত। দাম এক কিন্তু পুরো ঠকেছি। "রসিক বলল ..."দাম এক হলে কোয়লিটি আলাদা হবে না। অনেক সময় ভাত সিদ্ধ করার সময়ের হেরফের হয় জল ঠিক থাকেন। "এই নিয়ে বচসা চলছে। এক খদ্দের এসে বলল ..."লিখুন দাদা মাল গুলো। "কমলা কাগজ পেন নিয়ে মুখে বলে বলে লিখতে শুরু করল..."মটর ডাল পাঁচশ,ময়দা এক কিলো, সাদা তেল পাঁচশ । "এক বয়স্ক মহিলা দোকানের বেঞ্চে বসে খানিক জিরিয়ে রসিককে জি জ্ঞাস করল ..."কি গো তোমাদের ছেলে কেমন আছে। " কমলার লিখতে লিখতে হাতটা থেমে গেল চোখ তুলে তাকাল। রসিক চশমা খুলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল ..."কি বলব দিদি অমন জলজ্যন্ত ছেলেটা পাষাণ হয়ে গেল। "
..."কি করবে বল সবই কপাল।এত বড় দোকান একটামাত্র ছেলে তার এমন অবস্থা। "
             সন্ধ্যার বাজারে হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে সবজি বাজারে এসেছে রসিক। বাল্বের আলোয় চটের উপর সবজি বিছিয়ে বসে আছে সবজি বিক্রেতা। শীতের সন্ধ্যা। চারিদিকের কুয়াশা ভেদ করে বাল্বের আলো এসে পড়ছে মাছ গুলোর উপর। সারি সারি মাছের রূপলী আস্তরণ পেরিয়ে  রসিক খানিকটা এগিয়ে গেল। বাজারে আজ প্রচুর ফুলকপি  উঠেছে। ব্যাগে বড় বড় তিনটে ফুলকপি কিনে টম্যাটো দর করছে এক জন পরিচিত ভদ্রলোক এগিয়ে এসে রসিকের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল ..."আরে রসিক কি খবর। "রসিক বলল ..."আরে দাস দা।"
..."তোমার ভাইপোর খবর শুনলাম। কি করে ঘটল এমন। "
রসিক খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল তারপর বলল ..."ঝড় বাদলের দিন ছিল একটা বড় আম গাছের তলায় বাইক নিয়ে দাঁড়িয়েছিল হঠাৎ জোরে একটা বাজ পড়ে অাম গাছের ডালে। ডালটা ভেঙে পড়ে রমেশের মাথায়। মাথায় চোট লেগে একেবারে ঘিলু বেড়িয়ে  আসে অনেক ঘন্টার অপারেশন করে কোনও মতে প্রাণে বাঁচে কিন্তু এখন পুরো পাষাণ। খাইয়ে দিলে খায় উঠিয় বসালে বসতে পারে। জোয়ান ছেলেটা বাচ্চা হয়ে গেছে। "বলতে বলতে রসিক আবার চশমা খুলে চোখের জল মুছতে লাগল। নিজেকে খানিক সামলে বলল ..."বড়দের কথা না শুনলে বড় মুশকিল সে দিন বার বার বেড়তে বারণ করেছিলাম শোনে নি। জলজ্যান্ত ছেলেটা পাষাণ হয়ে গেল।" 

ব্লগে ব্যবহৃত ছবির সৌজন্যে গুগল












কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন