Translate

বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৭

সম্পর্কের সমীকরণ





           চঞ্চলের আজকের দিনটা ভালোভাবে মনে থাকবে৷জোড়ে অটো চলছে দুপাশ থেকে নাকে মুখে হাওয়া ঢুকছে মনের ভেতরে একটা সন্তোষ বোধ হচ্ছে৷চঞ্চলের বড় দাদা অপরূপের বার কয়েক সম্বন্ধ ঠিক হয়েও ভেঙে গেছে৷অপরূপের বত্রিশ বছর বয়স হয়েছে আত্মীয় পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে কানাঘুষা নানা কথা শোনা যাচ্ছিল৷শেষ পর্যন্ত চঞ্চল তার পিসেমশাইয়ের সঙ্গে বাগুইহাটিতে এসে মেয়ে পছন্দ করে৷তারপর দেখাশোনা সেরে আজ বিয়ের দিন ঠিক করে বাড়ি ফিরছে৷
               চঞ্চল আর অপরূপ তিন বছরের ছোট বড়৷বরাবরই দুই ভাইয়ের ভাব৷অপরূপ ভাইয়ের অত্যাচারে আজ অবধি নতুন শার্ট কিনে  পরতে পারেনি৷নতুন শার্ট কিনলে আগে চঞ্চল পরবে তারপর দাদা৷এই আবদার ভালোও লাগত অপরূপের৷অপরূপ শান্ত স্বভাবের লাজুক প্রকৃতির আর চঞ্চল তার ঠিক উল্টো৷সামনে দাদার বিয়ে ছোট বেলায় তাদের বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তাই বিয়ের সব দায়িত্ব এখন দু ভাইয়েরই৷চঞ্চল বিয়ের কার্ডে নাম লিখছে আর বলছে "মা তুমি একটু সামলে এত উল্টো পাল্টা বক না আগের বার পেতলের পিলসূচ চাইতে গিয়ে একটা সম্বন্ধ কেটে গেছে৷"মাও ক্ষেপে উঠে বলেন—"হ্যারে একা তোদের বড় করলাম এখন তুই আমায় কথা বলা শেখাবি৷"অপরূপ এসে ভাই ও মায়ের মাঝে মধ্যস্থতা করে৷বিয়ের পর চঞ্চল বৌদি সুবর্নাকে সবসময় আগলে রাখে৷ যতই হোক সে সম্পর্কে ছোট দেওর কিন্তু সম্বন্ধ করে তো সেই বলতে গেলে দাদার বিয়ে দিয়েছে তাই তার দায়িত্বও অনেক৷ আবার দাদা বৌদির সঙ্গে বেশীক্ষণ সময় কাটালেও মুশকিল তখন বৌদির উপর রাগ হয়৷চঞ্চল যতই বিজ্ঞঁ হওয়ার চেষ্টা করুকনা কেন ছেলে মানুষি তো তাকে ছাড়ে না৷অপরূপ তা বোঝে তাই বেশীর ভাগ জায়গায় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে যায়৷কয়েক বছরের মধ্যে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানও আসে ওদের পরিবারে৷ভাইঝিকে পেয়ে চঞ্চলের আননন্দের সীমা থাকে না অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ছোট মুন্নীকে নিয়ে খেলায় ব্যাস্ত হয়ে পরে৷মুন্নীর জন্য ক্লিপ,সুন্দর সুন্দর ফ্রক,খেলনা সব চঞ্চল নিজে হাতে কেনে৷
       অন্নপ্রাশনের দিন বাড়িতে লোকজনের ভিড় তারপর নানান ছোটখাটো নিয়ম কানুন পালন করতে হচ্ছে৷মুন্নী সকাল থেকে কান্না জুড়েছে মাসি, মামা ,দাদু কেউ সামলাতে পারে না৷চঞ্চল ছুটে এসে বলল "আমায় দাও ও আমায় চেনে ৷"মুন্নী তো কাকাকে দেখে ঝাঁপিয়ে চলে গেল৷চঞ্চল গর্বে বুক ফুলিয়ে মুন্নীকে কোলে নিয়ে বেশ দুলকি চালে প্রস্থান করল ৷সবাই বলাবলি করল"ও  চঞ্চল তোর বৌতো খুব ভাগ্যবতী হবেরে কি সুন্দর বাচ্চা সামলাতে পারিস"৷চঞ্চলের জেঠিমা বলল"এবার এই ছোড়াটার বিয়ের ব্যবস্থা কর ৷"তারপর সব মহিলারা উলুধ্বনী দিতে লাগলেন৷
           কয়েক বছরে চঞ্চলেরও বিয়ে হয়ে যায় ৷মুন্নীর বছর তিনেক বয়স সেই অধিকারের ব্যাপার কাকার উপর কাকিমার অধিকার ছোট হলেও এব্যাপারে মুন্নী সজাগ৷কাকিমার উপর মাঝে মাঝে রাগ হয় কাকিমা বকলে মিছিমিছি কাঁদে পাছে কাকা এসে কাকিমাকে বকে৷চঞ্চলের ট্যুরের চাকরি মাঝে মধ্যেই অফিসের কাজে ট্যুরে যেতে হয়৷সেই কাজের জন্যই শিলিগুড়ি যায় সেখান থেকে সবার জন্য জিনিস নিয়ে আসে নিজে হাতে প্যাকেট খুলে সব জিনিস দেখাচ্ছে এমন সময় চঞ্চলের স্ত্রী শতরূপা বলে ওঠে "ঐ গোলাপি ছাতাটা আমার"সঙ্গে সঙ্গে মুন্নী বলে"না আমার"৷মুন্নীর কথায় সবাই হো হো করে হেসে ওঠে৷'আমার আমার'বলে মুন্নীকে কোলে তুলে চঞ্চল গোল হয়ে ঘুরতে থাকে৷বিয়ে হলেও মুন্নীর প্রতি চঞ্চলের ভালোবাসায় ভাটা পড়েনি৷ বর্ষার এক সকালে চারিদিকে বৃষ্টিভেজা ৷সকাল থেকে বৃষ্টি কাজের লোক আসেনি সুবর্না বাসন মাজছে শতরূপা বাটিতে দুধ রুটি নিয়ে খাওয়াচ্ছে৷মুন্নী শতরূপার পেটে হাত দিয়ে বলল" এতে কি আছে কাম্মা"৷শতরূপা মুন্নীর মুখে চামচ তুলে বলল"তোমার ভাই আছে"৷সুবর্না কলের গতি কমিয়ে বলল"কেন বোনও হতে পারে"৷
—"কেন দিদি তোমার মেয়ে বলে কি আমারও মেয়ে হবে নাকি৷"দুই জায়ে মাঝে মধ্যেই অধিকার আর শ্রেষ্ঠ্যতের ঠান্ডা লড়াই চলে যা স্বাভাবিকও বটে৷মাঝরাতে শতরূপার লেবার পেন ওঠে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়৷সকাল বেলা চারিদিক রোদ ঝলমল পরিষ্কার আকাশ কয়েকদিন পর শতরূপা ছেলে কোলে ঘরে ঢোকে৷চঞ্চল মোবাইলে ভিডিও করে ছেলের গৃহ প্রবেশ রেকর্ড করে৷উলুধ্বনি ফুল ছড়িয়ে চঞ্চলের পুত্রের গৃহ প্রবেশ হয়৷বাড়িতে আয়া রাখা হয়েছে মুন্নী ছুট্টে গিয়ে ছোট ভাইকে ধরতে গেলে আয়া চোখ বড় করে বলে "তুমি হাত ধুয়েছ যাও এখন ধরবেনা"৷অপরূপ খবরের কাগজ ফেলে ছুট্টে মুন্নীকে কোলে তুলে নেয়৷যে মুন্নীর সঙ্গে  কেউ উঁচু গলায় কথা বলে না সবসময় তোলা তোলা করে রাখা হয় তাকে চোখ রাঙাবে আয়া? এব্যাপারটা অপরূপের মোটেই সহ্য হয়না৷
            নদীর বেগের মত সময়ও অতিবাহিত হয় গতি আসে চঞ্চল -অপরূপের সংসারেও৷ মুন্নী আর গুবলুও একটু বড় হয়েছ৷মুন্নীর জেদ বায়নাও দিনে দিনে বেড়েছে স্কুল থেকে ফিরে মুন্নী ব্যগ ওয়াটার বোতল ছুড়ে ফেলে টিভির সামনে বসে পড়ে৷দিদিকে দেখে ছোট্ট গুবলু পাশে এসে বসে পড়ে৷দুজনে কার্টুন দেখতে মগ্ন৷চঞ্চল দেখতে পেয়ে ছুটে এসে টিভি বন্ধ করে বলে "খালি টিভি নিজের চোখ খারাপ করবি সঙ্গে ভাইটারও"৷সুবর্নার দেওরের আচরণ ভালোলাগেনা তা বিরক্ত প্রকাশের মধ্যে বুঝিয়ে দেয়৷ মুন্নীও উচ্চ স্বরে কাঁদতে শুরু করে৷ছোট্ট ঘটনা অহেতুক অসন্তোষের কারণ হয়৷এদিকে  মুন্নীর স্কুলের পরীক্ষার রেজাল্ট বেড়িয়েছে বেশীর ভাগ বিষয়েই সে  'C'পেয়েছে৷ অপরূপ আর সুবর্না খুবই চিন্তিত ক্লাস টুতে পড়ে যদি এখনই  এত খারাপ হয় তবে উঁচু ক্লাসে কি করবে৷সুবর্না অপরূপকে বলল "আমি বুঝতে পারিনা ওর কোথায় অসুবিধা পড়ার সময় তো সব বোঝে৷"শতরূপা আটা মাখছিল৷আটা মাখতে মাখতে এসে বলল"দিদি আমার মনে হয় ক্লাসে লাস্ট বেঞ্চের বাচ্চা গুলো থাকেনা কিছু পড়া বোঝেনা কিন্তু ভয়ে জিজ্ঞাস করে না তারপর পরীক্ষায় ফেল করে৷ মনে হয় মুন্নীরও সেরকম কিছু অসুবিধা হচ্ছে"৷চঞ্চলও আলোচনায় যোগ দিল "হুম ,শতরূপা চাইল্ড সাইকোলজি ভালো বোঝে৷বৌদি ও ঠিকই বলছে৷"রেজাল্ট বিভ্রাট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শেও কোনও সমাধান করতে পারে না৷
         মুন্নীর জন্ম দিনের অনুষ্ঠানে সব কচিকাচাদের ভিড়৷অনেক গিফটের প্যাকেট চকোলেটের বাক্স এলোমেলো ভাবে ছড়ান৷গুবলু এক একটা গিফট দেখছে চকোলেটের বাক্স খুলে দু একটা মুখেও পুরছে৷এই দেখে অপরূপ সুবর্নাকে ঈশারা করে  সব তুলে রাখতে বলে৷মেয়ের অধিকারে গুবলুর হস্তক্ষেপ বরদাস্ত হয়না অপরূপের৷অপরূপ মেয়ের ব্যাপারে হঠাৎই যেন বেশী সংবেদনশীল বা মেয়ের অধিকার নিয়ে হয়ত একটু বেশী রক্ষণশীল হয়ে ওঠে৷একদিন দুপুরে মুন্নী আর গুবলুর মাঝে টিভির রিমোট নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়৷গুবলু মুন্নীকে ধাক্কা দেয় মুন্নীও ধপাস করে পড়ে যায় ৷অপরূপ হঠাৎ রেগে গুবলুকে ধমক দেয়"বড় সাহস হয়েছে তোমার এত বড় দিদিকে মারছ"৷সঙ্গে সঙ্গে গুবলুও কান্না জোড়ে রিমোট যুদ্ধ ছোটখাটো তান্ডবের রূপ নেয়৷এই ভাবেই চলতে থাকে সকলের জীবন৷অপরূপ আর চঞ্চলের মধ্যের ভালোবাসা কোথাও যেন ভাগ হয়ে যায় হয়ত ভাগ হয়ে যায় ওদের সন্তানদের মধ্যে৷
        সুবর্না ছোট থেকে ভালো কবিতা বলত বিয়ের পর সেইসব চর্চা চলে গেছে তাই সেই সখ পূরণের জন্য মুন্নীকে কবিতার ক্লাসে ভর্তি করে দেয়৷শতরূপাও সময় নষ্ট না করে গুবলুকে গিটার ক্লাসে ভর্তি করে দেয়৷বাড়িতে লোকজন এলে মুন্নী কবিতার বই আর গুবলু গিটার নিয়ে অতিথী দর্শকদের মনোরঞ্জন করে সঙ্গে সঙ্গে চলে সুপ্ত প্রতিদ্বন্দিতা ৷  সামনে পুজো তাই অপরূপ আর সুবর্না পুজোর শপিংএ বেড়িয়েছে৷কলিংবেলের আওয়াজে মুন্নী দরজা খুলে দেখে পাড়ার পুজো কমিটির সভাপতি মনোজ দত্ত৷মনোছ বাবু বললেন "চঞ্চল এবার পাড়ার ছোটদের নিয়ে পুজোর অনুষ্ঠান করব তাই বলতে এলাম৷"
—"হ্যা জেঠু গুবলু paticipate করবে ও ভালো গিটির বাজাতে পারে"৷শতরূপা গুবলুকে বলল"যা বাবু যা গিটারটা নিয়ে আয়"৷গুবলু নাচতে নাচতে গিটার এনে মনোজ দাদুকে শোনাচ্ছে চঞ্চল পাশে দাঁড়িয়ে পেছনে হাত রেখে মনোসংযোগের সঙ্গে ছেলের গিটারের টুং টাং শুনছে শতরূপা মনোজ বাবুর জন্য চায়ের কাপ এগিয়ে উদ্বিগ্ন ভাবে ছেলের দিকে চেয়ে রইল৷মনোজবাবু খুশী হয়ে বলে গেলেন"বাহ্ চঞ্চল তোমার ছেলের তো খুব প্রতিভা ওর নামটা আমি নিয়ে নিলাম এবারের বিজয়া সম্মিলনীতে ওর একটা সোলো পারফরমেন্স থাকবে৷"বাড়ি ফিরে অপরূপ সব শুনে বলে "মুন্নীও তো কবিতা বলতে পারে ওর নামটা দিলি না"৷চঞ্চল বলল"কই মুন্নীতো কিছু বলল না"৷বিজয়া সম্মিলনীতে গুবলু পারফর্ম করল৷অপরূপ সেইদিনই পরিবার নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল সুবর্নার বাড়ি বিজয়া করতে৷
        দিওয়ালীতে বাচ্চারা বাজি পটকা ফাটাচ্ছে৷মুন্নীকে ডেকে পাড়ার অল্প বয়সী মেয়ে নিরূপা বলল "মুন্নী দেখ তোর ভাই সকাল থেকে আমাদের বাড়ির সামনে পটকা ফাটাচ্ছে কিছু বলতে যাব তখন পালিয়ে যাচ্ছে এগুলো কিন্তু ঠিক হচ্ছে না৷"মুন্নী নিরুত্তাপ ভাবে উত্তর দিল "আমার ভাই নয় খুড়তুতো ভাই"৷
                চঞ্চল আর অপরূপের সন্তানদের মাঝে এই 'তুতো'সম্পর্ক  সকলের অলক্ষ্যে তৈরী করেছে একটা অদৃশ্য দেওয়াল৷যার উচ্চতা দিনে দিনে বাড়বে  কিন্তু এই দেওয়াল না যাবে ভাঙা না যাবে পার করা৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন