Translate

রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৭

বন্ধন

       

           শীতের রাত সকলের বাড়ির জানলা দরজা বন্ধ৷১৩/বি দেবেন্দ্র নাথ লেন একদম শুনসান৷স্ট্রীট লাইটের তলায় একটা নেড়ি কুকুর চেঁচিয়ে ঠান্ডায় গা গরম করছে৷ঐ কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে আসে পাশের পাড়ার দুতিনটে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না৷পাল বাড়ির ভিতরের পরিবেশটাও আজ নিঃস্তব্ধ৷বসুন্ধরা পাল তার স্বামী প্রকাশকে বলল"হ্যাগো,এমন দিন দেখব বলে কখনও ভাবিনি"৷প্রকাশ একটু হতাশ হয়ে বলল"না..."৷পাশের ঘরে  দরজার সামনে গিয়ে বসুন্ধরা ডাকল"কোয়েল... কোয়েল"৷কোনও উত্তর না পেয়ে ঘরে ঢুকে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে শুয়ে থাকা কোয়েলের  মাথায় হাত বুলিয়ে বলল"খেতে চল আর মুখ ভার করে থাকিস না৷তুই যা চাইছিস তাই করিস৷তোর বাবার আর আমার কোনও আপত্তি নেই৷"গায়ের থেকে কম্বল সরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল কোয়েল৷"সত্যি"৷—"হ্যা বাবা সত্যি এখন খাবে চল৷"
                  ইদানীং বসুন্ধরার কিছুই ভালোলাগেনা৷বসুন্ধরার একটা বুটিক আছে৷বুটিকের কাস্টমাররা বসুন্ধরার মিশুকে ব্যবহারের জন্য তার বাঁধা খোদ্দের হয়ে গেছে৷আজ বসুন্ধরার কোনও কাজে মন নেই৷এক অল্প বয়সী মহিলা কাঁথা স্টিচের উপর বিভিন্ন ডিজাইনার শাড়ি দেখতে চাইলেন৷বসুন্ধরা শাড়ি দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পরে এরই মধ্যে ঐ অল্পবয়সী মহিলার ছোট্ট ছেলে 'মা  মা  'বলে ছুটে ঐ ভদ্রমহিলাকে জড়িয়ে ধরতেই বসুন্ধরার বুকটা কেঁপে ওঠে৷একটা অজানা শক্তি অজান্তেই বসুন্ধরার মনটাকে দূরে উড়িয়ে নিয়ে যায়৷বর্তমান থেকে অনেক পিছিয়ে প্রায় পনেরো বছর আগে৷বসুন্ধরা আর প্রকাশের বিয়ের অনেক গুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও তারা সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিত ছিল৷ডাক্তার দেখাবার পর কিছু ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে প্রায় দিনই যেতে হত৷একদিন অন্যমনস্ক ভাবে হাসপাতালের লিফ্টের ভুল বোতাম টিপে উনি শিশুবিভাগে পৌঁছে যান৷বাচ্চাদের আকর্ষণে ঘুরতে ঘুরতে ভেতরে ঢুকে যান৷অনেক কচিকাচার মধ্যে গোল গাল চাঁপা গায়ের রঙের একটি ছোট্ট মেয়ে"মা...মা"বলে ডেকে বসুন্ধরাকে জড়িয়ে ধরে৷"মা তুমি এসেছ,আমি কবে থেকে তোমার জন্য বসে আছি"৷বসুন্ধরা চোখে জল ধরে রাখতে পারেনা শিশুটিকে কোলে তুলে বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদতে থাকে৷নার্স ছুটে এসে বলে—"আপনি চেনেন ওকে"
—"না সিস্টার কিন্তু ও আমায় মা বলছে যে"৷নার্স জানায় "ওকে ওর বাবা খুব অসুস্থ্য অবস্থায় আমাদের হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়৷প্রথম প্রথম দেখা করতে এসেছে তারপর বেপাত্তা৷আমরা অনেক খোঁজ করেছি কিন্তু ঠিকানা ফোন নাম্বার সব ভুল ছিল"৷বসুন্ধরা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল"তারপর ,তারপর কি হল?"
—"তারপর আরকি এখানকার ডাক্তার বাবুরা আর আমরা নার্সরা সবাই মিলে ওর দেখাশোনা করি৷ও যখন ওর মায়ের কথা জিজ্ঞাস করে তখন বলি একদিন তোমার মা ঠিক তোমায় নিতে আসবে কিন্তু আপনাকে দেখে এমন মা মা কেন করল কে জানে ও কিন্তু এরকম করে না৷"সব শুনে বসুন্ধরা বলল"তাহলে আপনি সব ব্যবস্থা করুন সিস্টার আমি সব আইন কানুন মেনে ওকে দত্তক নিতে চাই৷৷"ঐ হাসপাতাল থেকে চার বছরের ছোট্ট মেয়েকে দত্তক নেয় বসুন্ধরা ৷নাম রাখে কোয়েল৷বসুন্ধরা আর প্রকাশের জীবনে কোয়েল আসার পর ওদের জীবনের কেন্দ্র বিন্দু হয়ে ওঠে৷আর পাঁচ জন মা বাবার মতন তারাও স্নেহ দায়িত্বের সঙ্গে কোয়েলকে মানুষ করে৷মা বাবার স্নেহ মমতায় পুষ্ট কোয়েল আজ জেদ ধরেছে সে তার আসল বাবা মা কে খুঁজে বেড় করবে৷তাই বসুন্ধরার মন এত চঞ্চল আজ৷মনে হয় 'আসল বাবা মা'আমাদের পর করে দিলি কোয়েল৷প্রকাশ প্রথমে রাজি হয়নি কিন্তু মেয়ের জেদের কাছে পরাজিত হয়েছে৷কোয়েলকে সেই হাসপাতালের ঠিকানা দিয়েছে যেখান থেকে তারা ওকে এনেছিল৷কোয়েল যখন বড় হচ্ছিল সব বুঝতে শিখছিল তখনই বসুন্ধরা কোয়েলকে সব বুঝিয়ে ছিল৷বলেছিল কোয়েল ওদের পালিত কন্যা কিন্তু  বসুন্ধরা আর প্রকাশের জীবন কোয়েল ছাড়া অস্পূর্ণ৷তবু আজ কোয়েল তার বায়োলজিকাল প্যারেন্টস দের খুঁজতে চায়৷
                 কোয়েল হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে কোনও হদিস পায় না৷তবু সে তার সন্ধান অভিযান চালিয়ে যায়৷একদিন কাবার্ডের জামা কাপড় গোছাতে গিয়ে একটা প্যাকেট পায় বসুন্ধরা৷প্যাকেট খুলে কোয়েলের ছোট্ট বেলার সুন্দর কুঁচি দেওয়া গোলাপী ফিতের একটা ফ্রক পেল৷ফ্রকটা হাতে নিয়ে আবার অতীতে পাড়ি দিল বসুন্ধরা৷প্রথমবার স্টেজে উঠে এই ফ্রকটা পরে সুকুমার রায়ের 'নোট বই'কবিতাটা বলেছিল কোয়েল৷ভয়ে বার বার আমায় খুঁজছিল ওর চোখ আর আমি স্টেজের পেছন থেকে ওকে সাহস দিয়ে গেছি৷একটা গভীর শ্বাস ফেলে ভাবল তাহলে কোথায় ফাঁকি ছিল আমার যে আজ কোয়েল ওর আসল বাবা মাকে খুঁজতে মরিয়া হয়ে পড়েছে৷পাশের ঘর থেকে কোয়েল আর প্রকাশের মধ্যে কিছু নিয়ে তর্ক হচ্ছে৷প্রকাশের গলার স্বর ক্রমশ চড়ছে—"খবরের কাগজে দিয়ে কি হবে কোয়েল?তুই তো ফেসবুকে তোর ছোটবেলার ছবি হাসপাতালের নাম ঠিকানা সব দিলি কোনও response তো এলনা আবার খবরের কাগজ কেন?"
—"হয়ত ওদের ফেসবুক নেই কিন্তু খবরের কাগজ সবাই পড়ে"৷
—"তাদের ফেসবুক নাই বা থাকুক তাদের বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজন কেউই...."বসুন্ধরা প্রকাশের কথা কেটে বলল"ঠিক আছে ওর যা যা ইচ্ছে হচ্ছে ওকে করতে দাওনা৷"কোয়েল খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে রোজ অপেক্ষায় থাকত যদি কোনও আগন্তুক আসে তার খোঁজে কিন্তু কেউ এলনা৷ধীরে ধীরে কোয়েলের মাথা থেকে আসল বাবা মা খোঁজার ভূত নামল৷একদিন শীতের সকালে কোমল রোদে বসে বসুন্ধরা কোয়েলের মাথায় তেল মাখতে মাখতে বলল"হ্যারে কোয়েল আমাকে কি তুই নিজের মা বলে মানতে পারিস না"
—"কেন মা এ কথা কেন বলছ৷"
—"তবে যে তুই তোর আসল মা খুঁজতে বেড়িয়ে ছিলি৷"
—"অনেক ইচ্ছে হয়েছিল মা,একবার তাদের খুঁজে বের করি আর তাদের তোমার সামনে এনে বলি ভাগ্যিস তারা আমায় ঐ হাসপাতালে ফেলে চলে গিয়েছিল তাই তো আমি তোমায় পেলাম মা৷ওদের বলতে ইচ্ছে হয়েছিল আমায় ফেলে দিয়ে তোমরা আমার উপকারই করেছ৷আমি খুব সুখে আছি৷এই সুখ তোমরা আমায় কোনও দিনও দিতে পারতে না৷"এই বলে মা মেয়ে হেসে উঠল৷রৌদ্রজ্জ্বল শীতের সকাল তাদের হাসিতে আরও ঝলমল করে উঠল৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন