Translate

রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৭

বিজয়াদশমী






              মিষ্টির দোকানে বিশাল ভিড় বরুণ ঐ ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে কাঁচের শোকেজের উল্টোদিক থেকে সন্দেশে আঙুল রেখে বলল "এই সন্দেশগুলো ২০ টা আর রাজভোগ ২০ টা দিয়ে দাও৷"প্রচণ্ড গরম ভিড়ের মধ্যে  হাঁসফাস করছে৷আজ বিজয়াদশমী বাড়িতে ঠাকুমাকে বিজয়ার প্রণাম জানাতে আসবে সব আত্মীয়৷এবছর পুজো অনেক আগে হয়েছে৷ভাদ্র মাসের অস্বস্থিকর গরমটা  আশ্বিনের শুরুতে রয়েগেছে৷বর্তমানের গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রভাবে ঋতু বৈচিত্রেরও তারতম্য ঘটেছে৷বরুণের ঠাকুমার প্রায় পঁচাশী বছর বয়স পরিবারে উনই বয়ঃজ্যেষ্ঠ পিসি কাকারা সবাই আসেন বরুণদের বাড়ি ঠাকুমাকে প্রণাম করতে৷পুজোর চারটে দিন বরুনের ভালোই কাটে৷চারটে দিন কেন পুজোর আগে থেকেই পাড়ার পুজোর চাঁদা কালেকশন ঠাকুর আনা,ডেকরেটারদের তদারকি করা এসব ছোট খাটো কাজে পাড়ার বাকি ছেলেদের মত বরুণও যোগ দেয়৷তারপর পুজোর চারদিন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ঘুরে আড্ডা দিয়ে রোল খেয়ে ভালোই আনন্দে কাটে কিন্তু এই বিজয়া দশমী দিনটা বরুণের একদম না পসন্দ৷গ্র্যাজুয়েশনের পর প্রায় তিন বছর ধরে বরুণ বেকার বসে আছে৷এদিক ওদিক চেষ্টা করে কোনও মনপুতঃ চাকরি যোগার করতে পারেনি৷সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে হতাশা ছাড়া হাতে কিছুই আসেনি৷বিজয়ার  দিন বাড়িতে প্রচুর লোকের আগমন হয় প্রত্যেকের হাতে থাকে মিষ্টির প্যাকেট আর চোখে বরুণের প্রতি কৌতুহল৷এই অহেতুক কৌতুহলের কারণ হল বরুণের বেকারত্ব৷বরুণের বেকারত্ব যেন সকলকে তৃপ্তি দেয়৷এই কারণেই বিজয়া পর্ব তার না পসন্দ৷
               বাড়িতে ঢুকেই সিঁড়ির তলায় জুতো স্যণ্ডেল দেখে বরুণ আন্দাজ করে নেয় আত্মীয়দের আগমণ শুরু হয়েগেছে৷সিঁড়িতে উঠতে উঠতে ক্রমশঃ ভিন্ন ভিন্ন গলার স্বর স্পষ্ট হতে থাকে৷বরুণ মনে মনে বলল "বেহালার পিসি পিসে এসে গেছে"৷ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই এক মহিলা কন্ঠ স্বর ভেসে এল " কি রে বুড়ো কোথায় ছিলি এতক্ষণ"বরুণ একটু হেসে প্রণাম করে বলল"পিসি কেমন আছো?"
—"ভালো বস আমার পাশে"৷বরুণ বসল৷বরুণের পিসেমশাই অজিত সরকার কর্পোরেশনে উচ্চপদে কাজ করেন৷গোলগাল শ্যাম বর্ণের অজিত বাবু বরুণের পিঠ চাপড়ে জিজ্ঞাস করলেন "কি young manএখন কি করা হচ্ছে"৷এই প্রশ্নটা বরুণের কাছে সবথেকে বিরক্তকর৷বরুণ আশ্চর্য হয় সবাই জেনে শুনে কেন বার বার ওর বেকারত্বের ঘায়ে খোঁচা দেয় তারপর যখন নিশ্চিন্ত হয় যে বরুণ এখনও অবধি কিছু করে উঠতে পারেনি তখন পরম তৃপ্তি পায়৷বরুণ বলল "না সেরকম কিছুই না চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছি৷"এরপর অজিত বাবু বলতে থাকেন "না  না পরীক্ষা দিলেই হবে না যেখানে কাজ পাও ঢুকে পর ৷আগে ঢুকে পড়তে হবে৷অভিজ্ঞতা৷অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে৷বরুণ খানিকক্ষণ চুপ করে বিনামূল্যের পরামর্শ গ্রহণ করার পর উঠে যায়৷বাড়িতে হৈ চৈ হাসা হাসি চলছে৷বরুণদের দোতলা বাড়ি বাড়িটা ঠাকুরদার করা পুরনো দিনের বাড়ি চওড়া দেওয়াল উঁচু ছাদ ৷সামনের দিকের ঝুলন্ত বারন্দায় এসে দাঁড়াল বরুণ৷ঘরের মধ্যে বড্ড দম বন্ধ লাগছিল৷বরুণদের একতলায় ভাড়া থাকেন বসু পরিবার ৷বসুবাবু এক প্রাইভেট কোম্পানীর ইনসিওরেন্স এজেন্ট৷বসুবাবুর ছেলে ব্যাঙ্গালোরে অঙ্কে মাস্টার্স করছে৷যতক্ষণ পড়ছে যতক্ষণ engaged ততক্ষণ লোকে প্রশ্ন করে না প্রশ্ন শুরু হয় পড়া শেষ করার পর বা রেজাল্ট খারাপ হওয়ার পর৷গেটের সামনে আলো এসে পড়ল বরুণ একটু ঝুঁকে দেখল দিদি জামাইবাবু বাইকে করে হাজির৷
                  বরুণ আবার ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়াল ততক্ষণে বালিগঞ্জের বড় পিসি সল্টলেকের ছোট কাকা মেজ কাকা সবাই এক জায়গায় হয়ে গল্পের আসর ভালো জমে উঠেছে৷বরুণ চুপচাপ বসে মোবাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে লাগল৷বরুণের বাবা সরকারি চাকরি করেন আর্থিক অবস্থা মন্দ নয়৷বরুণের মা আর তাদের রাঁধুনী মিলে লুচি ভেজে সকলকে দিচ্ছে পিসি কাকিমারাও হাতে হাতে সাহায্য করছে৷চার বছরের বাবলু বরুণের কাছে গিয়ে বায়না করতে লাগল"মামা মোবাইল দাও গেম খেলব"৷বরুণ বাবলুকে চোখ রাঙাতেই বাবলু চিৎকার শুরু করে "ও কি চাইছে দিয়ে দে না বরুণ" এই বলে মেজ কাকা এগিয়ে এসে বাবলুকে কোলে তুলে নেয়৷খেতে বসে বরুণের ছোটকাকা বলল " বৌদি তোমার হাতের ছোলার ডাল আর ফুলকপির ঝোল এর তুলনা নেই ৷রমা তোমার ধারেকাছে আসতে পারবে না"৷রমা মানে বরুণের ছোট কাকিমা বলে উঠল "বাড়িতে তো দিব্যি চেটে পুটে খেয়ে নাও"৷বরুণের পাতে একটা লুচি দিয়ে বলল "বুড়ো ভালো করে খা,এখনই তো খাবি ইয়ং ছেলে৷তা এখন কি করছিস বাবা"৷বরুণ চুপ করে রইল৷বরুণের মা রান্নাঘর থেকে এসে বললেন "ও সরকারি চাকরির পরীক্ষা গুলো দিচ্ছে"৷
—"ও ভালো আমার দিদির ছেলে রাজু এই তো বরুণের বয়সী খুব চালাক ছেলে একটা বছরও নষ্ট করেনি এখন দিল্লীতে চাকরি করছে৷সামনের বছর দিদি বলছিল ওর বিয়ে দিয়ে একদম সেটেল করে দেবে"৷বরুণের মা একটা হতাশার সুরে বলল"আমার বরুণটার যে কবে গতি হবে"৷
—"চিন্তা করোনা দিদি সবাই তো সমান নয় ওরও হবে"৷বাবলুকে কোলে করে মেজ কাকা একটা চেয়ার টেনে বসল গম্ভীর সুরে বলল "দাদা বারান্দার দেওয়ালে ড্যাম্প ধরেছে তারপর কয়েকটা জায়গায় ফাটল দেখলাম"৷বরুণের বাবা ভাইদের মধ্যে বড় ধীর স্থির স্বভাবের বলল "হ্যা তাতো হবেই পুরোন বাড়ি"৷ছোটকাকা বেসিনের কলে হাত ধুতে ধুতে বলল"এখন কেউ পুরোন বাড়ি নিয়ে বসে থাকেনা দাদা৷প্রমোটারকে দিয়ে দাও তার আগে ভাড়াটে ওঠাবার ব্যবস্থা কর"৷বরুণের বাবা কিঞ্চিত চিন্তিত হয়ে বলল—"বাবার স্মৃতী এত বড় বাড়ি কয়েকটা ফাঁটলের জন্য প্রমোটারকে দেব৷সে তো সবাই মিলে সারাই করলেই হয়"৷
—"সবাই না,আমি নেই"৷এই বলে মেজকাকা লাফিয়ে উঠল৷"এই পুরনো বাড়িতে হাত দিতে গেলে অনেক খরচ আমি এখন টাকা বেড় করতে পারব না৷মেয়ে ম্যানেজমেন্ট পড়ছে তার জন্য ব্যঙ্ক থেকে লোন নিয়েছি"৷বাড়ি নিয়ে বাগবিতণ্ডা চলতে থাকে৷
            রাতে যে যার বাড়ি ফিরবে৷বরুণের ঠাকুমাকে নমস্কার করে একে একে সব বিদায় জানায়৷ছোটকাকা বরুণের ঠাকুমার চরণ স্পর্শ করে বলল "মা আজ আসছি ভালো থেকো"৷পঁচাশী বছরের বৃদ্ধা কম্পিত হস্তে ছেলের চিবুক ধরে ফ্যাকাসে দৃষ্টিতে বলল"আমি তো অনেক পুরোন হয়ে গেছি আমাকে কার কাছে দিবি৷"প্রশ্নটার উত্তর সেদিন কারো কাছেই ছিলনা৷
          ঘরের লাইট অফ করে খাটে শুয়ে শুয়ে বরুণ গুগল সার্চ করছে চাকরির ভ্যাকেন্সি দেখছে৷বাইরে ভালো হাওয়া ছেড়েছে জানলার পর্দা গুলো হাওয়ায় ফুলে উঠছে আবার হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জানলার গ্রিলে এসে ধাক্কা খাচ্ছে৷বরুণের মা বরুণের পাশে এসে বসল৷বরুণ মোবাইল পাশে রেখে মায়ের কোলে মাথা রাখল৷মায়ের ঠান্ডা আঙুল গুলো বরুণের চুল এলেমেলো করে দিল৷সারা দিনের কথায় প্রশ্নের আঘাতে ভারাক্রান্ত মাথাটা যেন পরম শান্তি পেল৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন