Translate

বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সস্তা মেয়ে

            

             সুপ্রিয়া সকাল থেকে বার বার জানলার সামনে দাঁড়াচ্ছে মাঝে   মাঝে দরজাটা খুলে বাইরে বেড়িয়ে একটু পায়চারী করে আবার ঘরে ঢুকে পরল৷আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখে চোখে মোটা করে কাজল টেনে নিয়ে বিভিন্ন কোণ থেকে মুখটা পর্যবেক্ষণ করে চুলের সামনেটা ঠিক করছে এমন সময় বাইকের পিপ্ পিপ্ শব্দ শুনে ছুটে গেল৷বাইক আরোহীকে দেখে উচ্ছল হয়ে বলল"এই আজ আসতে দেরি করলে যে"৷বাইক আরোহী বাইক থেকে নেমে বাইকের চাবি আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে সুপ্রিয়াদের ঘরে ঢুকল৷সুপ্রিয়ার বয়স সতেরো কি আঠারো৷ভর যৌবনের এই বয়সে সকলেই রূপবতী হয় সুপ্রিয়াও যৌবনের রূপে ধনী৷
           এই বয়স আবার কিছু পরিবর্তন আনে সকলের জীবনে যেমন বার বার নিজেকে আয়নার সামনে দেখতে ভালোলাগে ৷এই বয়সের মেয়েরা প্রসাধনী ব্যবহার করতে শেখে তারপর বিউটি পার্লারে গিয়ে নতুন নতুন হেয়ার কাট,আই ব্রো প্লাগিং, হাতে নখ বড় করা এই সকল সখ জন্মায় যৌবনের হাত ধরে৷যৌবন মেয়েদের রূপের পরিবর্তন ঘটায় আর মেয়েরাও রূপ সচেতন হয়ে যায়৷ব্যসন দিয়ে ফেসপ্যাক তৈরী করে মুখে লাগায় চুলের জন্য মাথায় ডিম দেয়৷বাচ্চা বয়সে যেগুলো অসহ্য লাগে যৌবনের ছোঁয়ায় সেগুলো সহনীয় হয়ে যায়৷ছেলেদেরও পরিবর্তন হয় বইকি তারা শরীর সচেতন হয়ে যায় দেহ গঠণ করতে ব্যয়াম কসরত শুরু করে, পেশী প্রদর্শণ করে৷এগুলো প্রকৃতির নিয়ম৷মনের কোণায় একটা অচেনা অনুভূতি উঁকি দেয় ঐ অনুভূতি উপভোগ করতে করতে মনও স্বপ্নের ডানা মেলে পাড়ি দেয় অচেনা দিগন্তে৷এই অচেনা অনুভূতিকে পরিপক্ক হৃদয় প্রেম নামে চিহ্নিত করে৷প্রেমের আবেগে আনকোরা মন খারাপ ভালোর তফাৎটা বিচার করতে পারেনা৷অনেকেই হয়ত পারে কিন্তু সুপ্রিয়া বিচার বোধের দিকে বড্ড বেশী অপরিণত ছিল৷সুপ্রিয়ার ঐ বাইক আরোহী বিরাট বড়লোক বাড়ির ছেলে বাবা ব্যবসাদার সে একমাত্র সন্তান৷ইন্দ্রজিৎ সান্যাল৷পোশাক পরিচ্ছদ চালচলনে ইন্দ্রজিৎ কে দেখে যে কেউ ধনী পরিবারেরই বলবে কিন্তু চেহারার দিক থেকে সে একবারেই সাধারণ৷মানে বাহারী কায়দায় পোশাকের পরিবর্তে কম দামের প্যান্ট শার্ট পরলে তারদিকে হত দরিদ্রও দৃষ্টিপাত করবে না৷
             সোফায় বসে ইন্দ্রজিৎ সুপ্রিয়ার হাত টেনে পাশে বসিয়ে নিল৷দুজনে নিবিড় ভাবে একেঅপরের সংলগ্নে বসে৷সুপ্রিয়ার মা ঘরে ঢুকে একগাল হেসে বলল"ওমা ইন্দ্র কখন এলে,তোমার জন্য আজ লুচি করেছি৷"ইন্দ্র একটু বিরক্তির সুরেই বলল"না না লুচি ঠুচি খাবনা আজ সুপ্রিয়াকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাব"৷সুপ্রিয়া এক লাফ দিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল—"ইন্দ্র আমায় আগে বলনি তো"৷
—"এই তো বলছি যাও যাও তৈরী হয়ে নাও"৷
       সুপ্রিয়া তাড়াহুড়ো করে মেরুন রঙে উপর সোনালী জরির কাজ করা একটা সিন্থেটিকের সালোয়ার কামিজ পরে নিল৷কিন্তু ম্যাচিং নেল পলিশ আর লিপস্টিক ছাড়া তো সুপ্রিয়ার সাজই অসম্পূর্ণ৷ওরই মধ্যে  সুপ্রিয়া সুন্দর ভাবে নেলপলিশ লাগিয়ে ফ্যানের সামনে হাত দুটো মেলে ধরল৷ইন্দ্রজিৎ অপেক্ষার পাত্র নয় বাইকে চড়ে স্টার্ট দিয়েছে৷সুপ্রিয়াও পড়ি কি মরি দৌড়ে বাইকের পেছনে চাপল৷ইন্দ্র স্পীডে বাইক চালাচ্ছে৷সুপ্রিয়া ইন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে বলল"ইন্দ্র তোমার সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার স্বপ্নের মতো লাগে৷তোমার বাইকটা হল রূপকথার পক্ষীরাজের ঘোরা আর তুমি আমার perfect dream man"৷সিনেমা হলে বসে সুপ্রিয়া দেখল নেল পলিশটা পুরো থেবড়ে গেছে৷এবার সিনেমা দেখায় আর কি করে মনযোগ দেয়৷নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে নেলপলিশ তুলতে তুলতে সিনেমার স্ক্রীনে "The End"ভেসে উঠল৷
                সুপ্রিয়ার বাবা পেশায় স্কুলের ক্লার্ক নেহাতই শান্ত নিরীহ প্রকৃতির মানুষ৷সংসারে সব দায়দায়িত্ব ভালোমন্দ উনি তার স্ত্রীর উপর দিয়ে খালাস৷স্ত্রীর মুখের উপর কোনও কথা বলার সাহসও নেই তার৷বাড়ি ফিরে মেয়ের কথা স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করায় উনি জানান"সুপ্রিয়া ইন্দ্রর সঙ্গে সিনেমা গেছে ফিরতে রাত হবে"৷পছন্দ না হলেও সব কিছু চুপ করে মেনে নেয় সুপ্রিয়ার বাবা৷
               ইন্দ্রজিৎ পুজোর শপিং করিয়ে দিয়েছে সুপ্রিয়াকে৷দামী দামী ড্রেস,জুতো,পারফিউম আরও অনেক কিছু যা ক্লার্ক বাবা কোনও দিন দিতে পারত না৷এই সকল সামগ্রীর বিনিময়ে সুপ্রিয়া নিজেকে অনেকটাই সপে দিয়েছে ইন্দ্রের কাছে৷ইন্দ্র ইচ্ছে মত সুপ্রিয়াদের বাড়িতে আসে নিজের মনোরঞ্জন আর ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য সুপ্রিয়ার শরীরকে খেলার সামগ্রীর মতো ব্যবহার করে৷সুপ্রিয়ার বড়দাদা,মা,বাবা সকলেই সবকিছু নিজ স্বার্থে মেনে নেয়৷বড় স্বার্থ বা বড় আশা বড়লোক বাড়ির ইন্দ্র সুপ্রিয়াকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে৷
              শপিং এর প্যাকেট খুলে খুলে সুপ্রিয়া আনন্দের সঙ্গে সব ড্রেস গুলো একে একে দেখছে ,আয়নার সামনে নিজের গায়ে ধরছে ঠিক এমন সময় পাড়ার ছোট্ট মেয়ে চুমকি এসে হাজির৷
"কি করছ সুপ্রিয়া দি"এই বলে সে ঘরে ঢুকল৷চুমকি ইন্দ্রজিৎকেও ভালোভাবে চেনে৷বছর চারের চুমকিকে ইন্দ্র বলল"এই চুমকি একটা খেলা দেখবি"৷চুমকি আনন্দের সঙ্গে বলল "কি খেলা দেখব দেখব"৷ইন্দ্র নতুন জুতোর বাক্স থেকে একটা চকচকে হাই হিল ল্যডিজ স্যান্ডেল বের করে সুপ্রিয়ার ঠোঁটে হালকা করে আঘাত করল৷তারপর জোড়ে আরও জোড়ে হাসতে হাসতে বলতে থাকল"দেখ মজাটা দেখ"৷সুপ্রিয়ার ঠোঁট ব্যাথায় লাল হয়ে গেল তবু 'হি হি হি'করে হেসে ও ইন্দ্রর খেলায় অংশ নিল কোনও প্রতিবাদ করল না৷ইন্দ্রজিৎ চুমকির দিকে তাকিয়ে বলল"কিরে চুমকি খেলাটা মজার না"৷
                দিনের পর দিন এভাবেই চলে ওদের জীবন৷তারপর ধীরে ধীরে ইন্দ্রজিতের আসা যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়৷চারিপাশের লোকজনের আলোচনার বস্তু হয়ে দাঁড়ায় সুপ্রিয়া৷পরিস্থিতির অবনতি দেখে  সুপ্রিয়ার মা ইন্দ্রজিৎকে ফোনে অনেক অনুরোধ করে বাড়ি ডাকে৷ইন্দ্র বাড়ি এলে সুপ্রিয়ার মা বলে"ইন্দ্র এবার তুমি সুপ্রিয়াকে বিয়ে কর নানা রকম কথা কানে আসছে মেয়েটার বদনাম হয়ে যাচ্ছে"৷ইন্দ্র তীক্ষ্ণ ভাবে হেসে বলল"বিয়ে,আমি তো কোনও দিন বলিনি যে আমি সুপ্রিয়াকে বিয়ে করব৷"সুপ্রিয়ার মা হতচকিত হয়ে বলে"একি বলছ ইন্দ্র,আমি সুপ্রিয়াকে তোমার সঙ্গে খোলামেলা ভাবে মিশতে দিয়েছি কারণ আমি তোমায় বিশ্বাস করেছিলাম তুমি নিশ্চই...."সুপ্রিয়ার মায়ের কথার মাঝেই ইন্দ্র উঠে দাঁড়াল৷"আমি চললাম মাসিমা৷আমার অনেক সখের মধ্যে সুপ্রিয়া একটা সখ ছিল৷আর ওর মত সস্তা মেয়েকে বিয়ে করার কথা আমি কোনও দিনও ভাবিনি"৷ইন্দ্র ঘর থেকে বেড়তেই দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল সুপ্রিয়া৷ইন্দ্রর হাতটা ধরে বলল"ইন্দ্র তুমি আমায় কখনও ভালোবাসনি"৷চোখের তলায় কালি রোগাটে চেহারার সুপ্রিয়ার দুচোখ ভর্তি জল ছাড়া কিছুই ছিলনা সেদিন৷ইন্দ্র বিদ্রূপাত্মক ভাবে তাকিয়ে বলল"কি চেহারা করেছ গো"পিছন ঘুরে সুপ্রিয়ার মাকে বলল"ওর বিয়ের ব্যবস্থা করুন আমি খরচ দিয়ে দেব৷"এই বলে ইন্দ্র নির্বিকারে বাইকে চেপে তীব্র গতিতে সুপ্রিয়াদের বাড়ি থেকে চলে গেল৷ইন্দ্র চলে গেল সুপ্রিয়াকে ছেড়ে ইন্দ্রর জীবনে আজ সুপ্রিয়ার কোনও স্থান নেই৷
              অতি সহজে যে জিনিস আমরা পেয়ে যাই তার প্রতি কদর বা আদর কোনওটাই থাকেনা আমাদের৷তা সাফল্য হোক,অর্থ হোক বা অতি সামান্য সেলের জিনিস হোক৷সস্তার জিনিস যা স্বল্প মূল্যে পাওয়া যায় তার আকর্ষনে আমরা সবাই যাই কিন্তু যত্ন করে রাখি কষ্ট করে পাওয়া দামি জিনিসটা৷সুপ্রিয়াও ইন্দ্রজিতের কাছে সস্তার ব্যবহারের দ্রব্য হয়ে গিয়েছিল যাকে ইন্দ্র ব্যবহার করে গেল কিন্তু যখন সম্মান দেওয়ার সময় এল তখন পিঠ দেখিয়ে চলে গেল৷সময়ের গতিতে এই সকল ঘটনা অনেক পিছিয়ে যাবে৷সুপ্রিয়ার জীবনে ইন্দ্রর আধিপত্য এক সময় অতীত হয়ে যাবে৷ইন্দ্রও হয়ত কোনও দেবী মূর্তির সম্মুখে হাত জোড় করে কৃপাপ্রার্থী হবে৷কিন্তু অতি সহজলভ্য কোনও কিছুই কি বাস্তবে সম্মান পায় নাকি শুধুই সস্তা হিসাবেই থেকে যায়৷


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন