Translate

মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সিদ্ধান্ত

           


          আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে খুব দেরি হয়ে গেছে৷কাল রাতে  জোড় বৃষ্টি এসেছিল ঘুমটাও খুব গাঢ় হয়েছিল৷আয়নার সামনে ঝুঁকে চোখে eye liner টানতে টানতে মহুয়া বলে উঠল "মা টিফিন প্যাক করে দাও আমি এক্ষুণি বেড়ব৷রিক্সা ডেকে উঠে পরল মহুয়া৷আজ খুব দেরি হয়ে গেছে আজ আর বাসের জন্য দাঁড়াতে পারব না ট্যাক্সি করেই চলে যাব৷হাতে চক ডাস্টার বোর্ডে ছবি এঁকে ভঙ্গিল পর্বত বোঝাচ্ছে মহুয়া ৷সব ছাত্রীরা মহুয়াকে খুব মেনে চলে৷মহুয়া তার প্রত্যেক ছাত্রীকে যত্নের সঙ্গে পড়া বোঝায় কখনও বিরক্ত হয় না৷ধীর স্থির ধৈর্যশীল চরিত্রের মালিক  হল মহুয়া রায়৷স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাস স্ট্যান্ডে একজন ভদ্রলোক প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকেন৷মহুয়া ৫৬ নম্বর ধরে চলে যায়৷ঐ ভদ্রলোক কোন বাসে ওঠে তা মহুয়া জানেনা প্রায়দিনই লক্ষ্য করেছে ভদ্রলোক মহুয়ার দিকে একবার তো তাকাবেনই ৷বেশী বয়স না ভদ্রলোকের লম্বা ছিপ ছিপে চেহারা কিন্তু মুখটা কেমন তা দেখেনি মহুয়া ৷একজন অচেনা পুরুষ মানুষের মুখের দিকে হাঁ করে দেখতে কেমন যেন বাধো বাধো লাগে৷তবে ফর্সা গয়ের রং গোঁফ আছে৷বাড়িতে ফিরে আর কোনও কাজ করতে ভালো লাগেনা৷সাড়ী ছেড়ে গা ধুয়ে সোজা বিছানায়৷কানে হেডফোন লাগিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে কখন যে চোখ লেগে যায় টেরই পায়না৷
              সুলেখা মহুয়াদের স্কুলে নতুন বাংলার টিচার৷আজ মহুয়া আর সুলেখা একসঙ্গে বাড়ি ফিরবে৷বাসস্ট্যান্ডে রোজকার মত সেই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে৷৫৬ নম্বরে আজ সুলেখা আর মহুয়া উঠে পরল৷সুলেখা বলল"মহুয়া বাসস্ট্যান্ডের ঐ ভদ্রলোক তোমায় দেখছিল৷"মহুয়া লজ্জা পেয়ে বলল "দ্যাত্ কি যে বল সুলেখাদি"৷একদিন হঠাৎই বাসস্ট্যান্ডের অচেনা ভদ্রলোক মহুয়ার কাছে এসে এক নিশ্বাসে বলতে লাগল"নমস্কার,আমি আপনাকে রোজ দেখি আমার নাম কার্তিক ঘোষ আমি ট্রেজারীতে ক্লার্কের চাকরি করি আমার আপনাকে খুব ভালো লাগে"এই বলে পকেট থেকে একটা কাগজে ফোন নাম্বার লিখে মহুয়ার দিকে এগিয়ে বলে "এটা আমার contact number"৷এরপর থেকে বাসস্ট্যান্ডে তাদের দেখা হলেই হাসির বিনিময় কিছু আলাপচারিতা তারপর কথা গল্প বাস মিস হয়ে যাওয়া এবং হোয়াটসআপ ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধুত্ব তারপর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷এদিকে মা তো সব টের পায়৷একদিন জিঞ্জাসা করলেন"মৌ তোর বাড়ি ফিরতে প্রায়ই দেরি হয় কেন বলত"৷মহুয়াকে বাড়িতে মৌ নামেই ডাকা হয়৷মৌ একটু ইতস্তত করে বলে উঠল"কই দেরি না তো"৷তারপর খানিক সামলে"মা আমি একজনকে পছন্দ করি তুমি আর বাবা একবার দেখা করবে ওর সঙ্গে"৷কার্তিক তার বাবা মার সঙ্গে চলে আসে মহুয়ার বাড়ি৷মহুয়ার মাথায়  ঘন মোটা চুল কপালটা ছোট্টো মোটা মোটা ভ্রূ৷হাতে পায়ে লোমের আধিক্য একটু বেশী৷ফর্সা গায়ের রঙে হয়ত একটু বেশী লোমশ বলে মনে হয়৷মহুয়াকে দেখে কার্তিকের মা বললেন"আজ কাল ছেলে মেয়েরা নিজেই দেখাশোনা করে নিচ্ছে আমরা তো কিছুই নই৷তবে মেয়েদের গায়ে এমন লোম কিন্তু ঠিক লক্ষ্মীমন্ত লাগে না৷"মহুয়া বাবার অমতেই জেদ করেই কার্তিককে বিয়ে করে৷
               মহুয়া চাকরির সঙ্গে সংসার ভালোই সামঞ্জস্য করে চলে৷ব্যাগ ভর্তি বাজার করে কলিং বেল বাজাতে কার্তিক দরজা খুলেই প্রশ্ন করে"রিক্সার হর্ণের আওয়াজ পেলাম তুমি কি রিক্সা করে এলে নাকি?"মহুয়া ব্যাগ বোঝাই বাজার নিয়ে ঘরে ঢুকে আচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বলল"হ্যা গো এত বোঝা"৷সঙ্গে সঙ্গে কার্তিক গম্ভীর সুরে বলল"এসব আর  হবেনা রিক্সায় পয়সা নষ্ট আমি বরদাস্ত করব না"৷মহুয়া যেন প্রথম একটা হোঁচট খেল৷বিয়ের কয়েকদিন পরই মহুয়া দেখে কার্তিকের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে অথচ ভালোমন্দ খাওয়া চোখের সামনে দেখলে কোনও সময়ই সংযম করতে পারেনা তাই স্বামীর স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে সেও পাতলা ঝোল ভাত খেয়েই থাকে৷দুটো ছেলে মেয়ে হয়ে গেছে তারাও বাবার ভালো স্বাস্থ্যের জন্য লুচির বায়না করতে পারেনা৷একদিন লুচি করার অপরাধে কার্তিক সব খাবার ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল তার সঙ্গে তুমুল অশান্তিও করে৷মহুয়া রিক্সা করলে বাড়ির সামনে দাঁড় করায় না দূরে রিক্সা ছেড়ে বাকি পথ হেঁটে বাড়ি আসে৷কার্তিক জানলে আবার অশান্তি করবে৷পুজোর ছুটিতে সবাই মিলে পুরি বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান হয়৷অনেকদিন পর বাইরের হাওয়ায় যদি রোজকার অশান্তি থেকে কিছুদিন ছুটি পাওয়া যায় এই আশা নিয়ে ছেলে মেয়ের হাত ধরে ট্রেনে উঠে পরল মহুয়া৷হোটেলের রুমে ভোর বেলায় ঘুমন্ত কার্তিকের মাথার আলতো করে  হাত বুলিয়ে  কানের কাছে আস্তে করে মহুয়া বলল"শুনছো চলনা এক সঙ্গে sun rise দেখে আসি"৷কার্তিক মুখটা বিরক্ত করে ওপাশ ফিরে শুয়ে পরল৷দুপুর বেলা ছেলে মেয়েদের পছন্দের খাবার অর্ডার করে মহুয়া হঠাৎ দেখে একজন অপরিচিত মহিলার সঙ্গে কার্তিক খুব সাবলিল ভাবে কথা বলছে যেন অনেক দিনের চেনা৷মহুয়া কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করল "উনি কে গো"কার্তিক খোশ মেজাজে বলল"ও সুস্মিতা এখানেই আলাপ হল শোন আমি কাল ওর সঙ্গে কোনারক যাচ্ছি৷৷"মহুয়া যেন এবার একটা জোড়ে ধাক্কা খেল৷বাড়ি ফেরার সময় ট্রেনে কলেজের বন্ধু দেবরাজের সঙ্গে দেখা হল মহুয়ার৷"আরে দেব কেমন আছিস কত বছর পর দেখা"৷অনেক দিন পর পুরনো বন্ধুকে দেখে পুরনো দিনে ফিরে গিয়েছিল মহুয়া৷প্রাণখুলে হেসেছিল সেদিন৷বাড়ি ফিরতেই কার্তিক সব কিছু ছুড়ে ছুড়ে ফেলছে"ট্রেনে ঐ বজ্জাত লোকটার সঙ্গে অত হাসা হাসি করছিলে কেন এই তোমার চরিত্র "বলে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ওঠে৷মহুয়া মাথা ঠান্ডা রাখতে না পেরে চিৎকার করে বলে"চরিত্র..চরিত্রের সার্টিফিকেট তুমি দেবে"৷প্রথমবার মহুয়ার কাছ থেকে জবাব শুনে রাগে কার্তিক মহুয়ার গালে সজড়ে এক থাপ্পড় মাড়ে৷ছোট মেয়েটা ভয়ে কেঁদে ওঠে৷মহুয়া স্তম্ভিত হয়ে খাটে বসে পড়ে৷ছেলে মেয়ের প্রতি কুপ্রভাব পরবে ভেবে মহুয়া চুপ হয়ে যায়৷
            কার দোষ আমার?আমি জেদ করে এই লোকটাকে বিয়ে করেছিলাম৷আমি আমার সুন্দর জীবনটাকে নিজে হাতে তছ নছ করলাম৷এখন স্কুলের মেয়েদেরও আগের মত গুছিয়ে পড়াতে পারিনা৷একটা প্রশ্ন কেউ দুবার জিজ্ঞাস করলেআমি বিরক্ত হই৷স্কুল থেকে বাড়ি ,বাড়িতে এসে অমানুষিক পরিশ্রম করি রিক্সার পয়সা বাঁচাই৷আমি বদলে যাচ্ছি,আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি,শুধু এই লোকটার জন্য?এই অজস্র চিন্তায় মাথাটা ভার হয়ে আসে মহুয়ার৷হঠাৎ কলিং বেল বাজে দর্জা খুলে দেখে"বাবা এস এস ভর দুপুরে এত রোদে কেন এলে বাবা৷"মহুয়ার বাবার চোখ মুখ শুকনো বললেন"আমি retire করেছি পেনশন নেই কিন্তু কষ্টে শিষ্টে তোর মায়ের আর আমার খরচ চালাবার মত আমার ক্ষমতা আছে রে মৌ তাই তুই মাস গেলে তোর মায়ের হাতে আর খরচের টাকা দিস না"৷"কেন বাবা হঠাৎ এমন কথা কেন বলছ আমার এমন কথা শুনলে বড় কষ্ট হয়৷"মহুয়ার বাবা সেদিন জল পর্যন্ত না খেয়ে চলে যায়৷পরে মহুয়া জানতে পারে কার্তিক ওদের বাড়িতে গিয়ে টাকা পয়সার ব্যাপারে খুব চিৎকার চেঁচামিচি করেছে এমনকি পাড়ার লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল৷
               স্কুলে সুলেখাদি মহুয়াকে বলে"কিরে মহুয়া কেমন শুকনো দেখাচ্ছে শরীর খারাপ৷" "সুলেখাদি আজ তোমার সঙ্গে যাব মায়ের সঙ্গে অনেক দিন দেখা করিনি৷"বাসে বসে মহুয়া সুলেখাকে বলে"সুলেখাদি আমি বোধ হয় কার্তিকের সঙ্গে সম্পর্কটা টানতে পারব না৷এই বলে হঠাৎ বাসের জানলার দিকে চোখ পড়ে, দেখে ফুটপাথের ঝুপড়িতে এক কম বয়সী স্ত্রীলোক চিৎকার করে ঝগড়া করছে আর তার স্বামীকে বার বার ধাক্কা দিয়ে অনর্গল গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে আসে পাশের লোকজন সবাই ঐ স্ত্রীলোককেই সমর্থন করছে৷ট্রাফিকের জন্য বাসটা ক্ষানিকক্ষন দাঁড়িয়েছিল তাই এ দৃশ্য দেখল মহুয়া আর সুলেখা৷মহুয়া বলতে লাগল— "ও যখন আমার বাবা মা কে অপমান করেছে তখন ওর সঙ্গে থাকা মানে আমি আমার রুচী শিক্ষা সংস্কার সব কিছুর অপমান করছি৷" —"বোকামি করিসনা মহুয়া তুই ব্যাঙ্কে হোম লোন নিয়ে বাড়ি করলি তাও আবার কার্তিকের নামে ৷এখন বলছিস আলাদা হবি৷"
— "কেন সুলেখাদি ঐ ফুটপাথের ঝুপড়ির মেয়েটার যদি সাহস থাকে তবে আমার কেন থাকবে না৷"
—"আরে ও তো লেখা পড়া জানেনা একটা ছোটলোকের সঙ্গে তুই নিজেকে গুলোচ্ছিস৷"
—"হ্যা গো সুলাখাদি ঐ মেয়েটা অক্ষর চেনেনা কিন্তু ঠিক বেঠিক জানে প্রতিবাদ করতে জানে বিচার পেতে জানে"৷
           সকালবেলা ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে মহুয়া কার্তিকের সামনে ধরে৷খবরের কাগজের শেয়ার বাজারের খবরে মগ্ন কার্তিক খবরের কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞাস করল"কি এটা"মহুয়া একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল"আমি সই করে দিয়েছি তুমি সই করলে ডিভোর্সটা মিউচুয়ালী হয়ে যাবে ৷না হলে কোর্টে গেলে বৃথা সময় নষ্ট হবে৷"কার্তিক ঔদ্ধত্য হয়ে বলে"তোমার খুব সাহস হয়েছে আমায় ডিভোর্স দেবে"৷মহুয়া আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে "সাবধান"রাগে অপমানে খেঁকিয়ে বলে" আমি টাকা পয়সা খোরপোশ কিচ্ছু দেব না"৷মহুয়া তাচ্ছাল্যর সঙ্গে হেসে বলল"তোমার মত হা ঘরের ছেলে দেবে আমায় টাকা পয়সা এই বাড়িটা আমি তোমায় তোমার আশ্রয় হিসাবে দান করে গেলাম৷"এই বলে দুই ছেলে মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে গেল মহুয়া৷
           সকালবেলা  ঠাণ্ডা একটা হাত মহুয়ার কপাল স্পর্শ করল৷"মৌ আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি করলি মা"৷মহুয়া ওর মায়ের হাতে চুমু খেয়ে বলল"না মা এত দিন পর আমি ঠিক সময়ে উঠেছি"৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন