Translate

মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

মনের ব্যথা

           
           দূর থেকে ভেসে আসা অস্পষ্ট সুর ধীরে ধীরে পরিষ্কার ভাবে শ্রুতি গোচরে এল"বালতি...গামলা..."৷রান্না ঘর থেকে লতিকা চেঁচিয়ে বলল"মোম ডাকত বাসনয়ালা কে"৷ছুম ছুম করে নুপুরের তালে ছুটে গিয়ে জানলার শিখ ধরে ফর্সা  টুকটুকে মোম হাকল "এই বালতি গামলা দাঁড়াও মা ডাকছে৷"দরজা খুলে বাসনয়ালার সঙ্গে ব্যস্ত লতিকা এমন সময় পাড়ার মিশ্র মাসিমা বলে উঠলেন" মোম নয় গো মোমের মুতুল কি মিষ্টি কি মিষ্টি" "আর বলবেন না মিশ্রমাসিমা  মিষ্টি না দুষ্টু তারপর দশ বছর বয়স হয়েছে বুদ্ধি হয়নি বলি বোন ছোট আমায় এত জালাস না৷দুজনকে নিয়ে আমি নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি"৷মোম আর মাম্পির দশ বছরের তফাৎ৷মোমের একছত্র রাজত্বে মাম্পির অনুপ্রবেশ মোমের মোটেই ভালো লাগেনা"বাবা এত জামা এত পুতুল সব আমার জন্য এনেছ তো"এই বলে মোম ছুট্টে গিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরল৷মোমের বাবা সুরেশ নাগ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার৷সুরেশ মোমের কপালে চুমু খেয়ে মোম কে কোলে তুলে বলল"তোমারও আছে কিন্তু তুমি তো বড় হয়ে গেছ মা কাল বনুর প্রথম জন্ম দিন৷"
            সকাল থেকে প্রচুর লোকজনের আগমন বড় কেক এসেছে মোম ছুট্টে গিয়ে দিদার কোলে বসল"দিদা মাম্পির জন্য এত গুলো জামা কেন এনেছ"৷স্থুলকায় স্নেহময়ী মোমের দিদা সস্নেহে মোমের গালে স্পর্শ করে বললেন"বনু তো খুব  ছোট হিসু করে জামা ভিজিয়ে দেয় তাই এত জামা৷"চারিদিকে হৈ চৈ সবাই ছোট্ট মাম্পিকে নিয়ে ব্যাস্ত৷লতিকা মোমের হাত ধরে সকলের কাছে নিয়ে আসে "দেখ দেখ এত বড় মেয়ে জামাটাকে কিভাবে ভিজিয়েছে বলে নাকি toilet করতে গিয়ে ভিজে গেছে"এই কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে৷ছুটির দিনের এক অলস সন্ধ্যে বেলায় মোম বাবার কোলে বসে আছে হঠাৎ আবদার করল "বাবা মনে আছে আমি যখন ছোট ছিলাম তখন তুমি কিরকম ঘোরা হতে"৷সুরেশ আনন্দের সঙ্গে বলে উঠল"যাও যাও বনুকে আজ আমার পিঠে বসিয়ে দাও খুব মজা  পাবে মাম্পি"বাবা আমি ৷তুমি বড় হয়ে গেছ মোম ৷সময় এগোতে থাকে তার সঙ্গে সঙ্গে বয়স বৃদ্ধি পায় জীবনেরও পরিবর্তন হয়৷মোমের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল খুব খারাপ হয়েছে৷মোমের বাবা অনেক আশা করেছিলেন  মোমের কাছ থেকে৷ভালো বই প্রতি বিষয়ে মাস্টার মশাই কোনও কিছুর ত্রুটি রাখেননি৷রেজাল্ট হাতে নিয়ে সুরেশ মোম কে বলে"এত খারাপ কি করে হয় মোম তোমার পড়া শোনার কোনও ত্রুটি রাখিনি আমি৷মাম্পি অত ছোট স্কুলের admission test এ first হয়েছে৷বোনের থেকে কিছু শেখে"৷মোম বিদ্রোহী হয়ে বলে ওঠে "মাম্পি মাম্পি আমার সঙ্গে ওর তুলনা করবে না৷মাধ্যমিক ওত সোজা নয়৷"মোম শৈশব থেকে সদ্য যৌবনে পা রেখেছে এই সময় স্বভাবে চেহারায় না না পরিবর্তন আসে ৷মোম ছেলে বেলা থেকেই সুন্দর যুবতী মোমের রূপে সকলেই আকর্ষিত হয়৷সুন্দর করে কাটা চুল নিখুঁত ভাবে শেপ করা নখ৷সাজ পোশাকেও পরিপাটি মোম৷
             কয়েকদিন ধরে মোমের মা খুবই অশান্তিতে ভুগছেন৷সেদিন বাজারে মিশ্র মাসিমা বলেছেন বাড়িতে কেউ না থাকলে একটা ছেলে মোমের সঙ্গে দেখা করতে আসে৷যদিও মিশ্র মাসিমা কে উনি বলেছেন "আমার মোমের উপর পুরো বিশ্বাস আছে৷"কিন্তু তারপর থেকে মোমের উপর কড়া নজর রাখতে শুরু করেছে লতিকা৷মার তার প্রতি কড়াকড়ি আর বোনের জন্য মমতা মোমের কাছে অসহনীয় লাগে৷কোথায় যেন কিছু হারিয়ে যাচ্ছে৷মোম খুঁজতে থাকে তার জীবনের হরিয়ে যাওয়া গুরুত্ব৷বাবা মা র কাছে প্রাধাণ্য আদর বায়না সব৷হঠাৎ করে তুমি বড় হয়ে গেছ এই কথাটা মোটেই ভালো লাগেনা তার বোন ছোট তাই ও আদর খাবে বায়না করবে আর আমি বড় তাই বোঝদার হব এই সমীকরণ মেলাতে পারেনা মোম৷পড়ায় মন নেই উচ্চমাধ্যমিকে দুটো বিষয়ে ফেল করে মোম৷প্রত্যেক নতুন বছরের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বয়স বাড়ে অভিজ্ঞঁতা বাড়ে কিন্তু মোম আজও অনেক পিছিয়ে রয়েগেছে৷
               রাত প্রায় ৮টা তখনও মোম ঘরে ফেরেনি৷লতিকা সুরেশ সর্বত্র খুঁজেও মোমের দেখা পায় নি৷পুলিশে খবর দেওয়া ছাড়া উপায় নেই দেখে দুজনে পুলিশে missing diary করে৷পরের দিন সন্ধ্যে বেলায় পুলিশ সুরেশকে জানায় মোমের সন্ধান পাওয়া গেছে তাকে সঙ্গে যেতে হবে৷তৎক্ষনাৎ সুরেশ পুলিলের জিপে উঠে পরে৷লতিকা  মোমের জন্য অধির অপেক্ষায় বসে থাকে৷পুলিশের জিপ গলি ঘুপচি দিয়ে একটা অন্ধকার গলিতে এসে দাঁড়ায়৷সুরেশের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় এ আমাকে কোথায় আনলেন স্যার৷পুলিশ কর্তা জানায় আপনার মেয়ে এখানেই আছে৷একটা নীচু ছোট দরজায় পুলিশ কড়া নাড়ায় এক মহিলা দরজা খোলে ৷পুলিশ ঘরে ঢোকে সঙ্গে সুরেশ ৷ছোট একটা ঘর হাওয়া বাতাস নেই ৷ঘরের মাঝখানে একটা চৌকি তাতে একটা রং ওঠা চাদর পাতা টিম টিম করছে একটা বাল্ব আর ঐ চৌকির উপর   পুরো ঘর আলো করে বসে আছে মোম৷পুলিশ জানায় আপনার মেয়ে ওনার ছেলে আলতাভ কে বিয়ে মানে নিকা করেছে ওর তো এবছরই আঠারো হয়েছে তাই ও সাবালিকা৷সুরেশ যেন আকাশ থেকে পড়ল সুরেশের চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না৷ দু হাত বাড়িয়ে মোমকে বলে"আয় মা বাড়ি চল  এমন ছেলে মানুষি করতে নেই মা"বলতে বলতে সুরেশের চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে গলা নোনতা লাগে ৷মোমের চোখে মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয়"মোম না আমি এখন রেশমা বাবা আমি তো বড় হয়ে গেছি আমি নিজের ডিসিশন নিজেই নিতে পারি৷"সুরেশ উত্তেজিত হয়ে যায় ঝাপসা করা চোখের জল হঠাৎ শুকিয়ে যায়৷সুরেশ বলে"আজ যদি তুমি আমার সঙ্গে ফিরে না চল মোম তবে কোনও দিন বাড়ি ফিরতে পারবে না আমি তোমায় আর ঐ বাড়িতে ঢুকতে দেব না৷"মোম দৃঢ়তার সঙ্গে বলে"বাড়ি ফিরব বলে তো আলতাভ কে বিয়ে করিনি"৷সুরেশ মেয়ের ঔদ্ধ্যত্ততা সহ্য করতে পারে না সেখান থেকে বাড়ি ফিরে যায়৷
           আলতাভের বিরাট পরিবার ৷মোম আলতাভের বাবা মা কে আব্বা আম্মি বলে ডাকে৷তামাটে গায়ের রং বাদামি চুল কোলে এক শিশু বিছানায় আরেকজন৷এই মেয়ে মোম নয় রেশমা৷দুপুর বেলায় অন্যমনস্ক ভাবে শিশুকে স্তন পান করাচ্ছিল রেশমা শুষ্ক রুক্ষ চুল চোখের কোনে কালি মাঝে মাঝে পেটের কোনায় খুব ব্যথা হয়৷কোমর ব্যথায় একটানা বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা৷জানলার দিকে তাকিয়ে থাকা রেশমার ফ্যকাসে  চোখ  দুটো খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছে৷হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এল"বালতি...গামলা...."সুর করে ভেসে আসা শব্দ গুলো ধীরে ধীরে দূরে কোথাও মিলিয়ে গেল৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন