Translate

বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

এক দিন রাত্রে

সালটা ১৯৬৪ সেই সময় কোলকাতায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা লেগেছিল৷তখন বাংলা দেশ নিজ অস্তিত্ত্বে আসেনি৷পাকিস্থানে অন্তর্ভুক্ত ছিল৷পাকিস্থানের হিন্দুদের হত্যা করায় ভারতবর্ষে মুখ্যত কোলকাতায় রয়েট লাগে৷যেহেতু ভৌগলিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গ সেই সময়ের পাকিস্থানের  কিছু অংশ যা বর্তমানে বাংলাদেশ তার পাশা পাশি অবস্থান করে সেহেতু  এই রায়টের প্রভাব বঙ্গের মানুষকে প্রত্যক্ষ ভাবে সামনা করতে হয়েছিল৷সাধারণ বাড়ির মানুষজন সবসময় আতঙ্কে দিন কাটাত৷মুসলমানদের আল্লাহ হো আকবর রব শোনা মাত্রই হিন্দুরা তট্স্থ হয়ে যেত আবার বন্দেমাতরম রবে মুসলমানরা আতঙ্কিত হত৷ঘটনা বয়ে গেলেও কিছু কিছু ঘটনা মানুষের মনে নাড়া দিয়ে যায়৷জায়গাটা কোলকাতা থেকে অনেকটাই দূরে ৷আশে পাশে বাড়ি ঘরের সংখ্যা খুবই কম৷একটি বাড়ির বেশ খানিকটা দূরে আরেকটি বাড়ি৷খোলা মাঠ বনজঙ্গলের আধিক্যও বেশী৷কিছু কিছু পাকা বাড়ি তৈরীর কাজ চলছে ৷এই খানেই বাস দেব চৌধুরীর৷দেব বাবু পেশায় সরকারি ড্রাফ্টস ম্যান ছিলেন৷অনেক দিন হল অবসর প্রাপ্ত৷দীর্ঘ্য শীর্ণকায় দেব বাবুর বিশাল পরিবার৷তখনকার দিনে অবশ্য সকলেরই বড় পরিবার হত৷দেব বাবুর ছয় কন্যা ও দুই পুত্র৷কন্যারা সকলেই বিবাহিত৷দুই পুত্র নবীন চৌধুরী ও তারক চৌধুরী ৷নবীনের চেহারা হাট্টা গোট্টা লম্বা চওড়া শ্যাম বর্ণ আর তারক ছিপ ছিপে স্বল্প দৈর্ঘ্য৷তারক ছোটবেলা থেকে খুব ডানপিটে তেমন সাহসী৷দেব বাবুর বড় ছেলে নবীন কোলকাতার এক মিলের হেড ক্লার্ক আর তারক রেলে চাকরি করে৷দু জনেই বিবাহিত তারকের স্ত্রী অন্তসত্ত্বা তাই বর্তমানে উনি বাপের বাড়িতে আছেন৷নবীনের তিন কন্যা তুলী বয়স ৮ গৌরী ৬ আর ননী সবে ৩ মাস৷নবীনের স্ত্রী রমা খুবই সাদা মাটা সারা দিন গৃহ কর্মে যুক্ত৷রমা বেশীর ভাগ সময় ননীকে দেব বাবুর কাছে শুয়ে রেখে নিশ্চিন্ত মনে সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেন৷দেব বাবুর স্ত্রী অর্থাৎ রমার শাশুড়ি সংসারের ঝামেলায় থাকেন না৷ উনি পাড়ায় আড্ডা দিয়ে আর তাস খেলে সময় কাটান৷দেব বাবু তার নাতনীদের প্রাণের বন্ধু৷বয়সের কারণে এখন ভালোভাবে হাঁটা চলা করতে পারেন না বেশীর ভাগ সময় বিছানায় শুয়ে কাটান আর নাতনীদের গল্প শোনান৷তুলী ও গৌরী স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতেই দাদুর কাছে সব অভিযোগ দিনের বৃত্যান্ত নিয়ে বসে পরে৷দেব বাবুর বাড়ির সামনে একটা খোলা মাঠ আছে ঐ খানেই পাড়ার সব ছেলে মেয়েরা খেলা করে৷মাঠ পেরলে এক বিরাট অট্টালিকা৷এই অট্টালিকা এলাকার বিখ্যাত ডাক্তার ডঃব্যাণার্জীর৷আশে পাশের লোকজনকে সতর্ক করা হয়েছে কোন বিপদ দেখলে এই ডাক্তার বাবুর বাড়িতে এসেই জড়ো হতে হবে৷ ডাক্তার বাবু সুরক্ষার নানা ব্যবস্থা করে রেখেছেন আবার ওনার কাছে বন্দুকও আছে৷আল্লাহ হো আকবর ধ্বণিত হলেই সকলে এই খানে এসেই আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় নেবে৷এই খোলা মাঠের কিছু অংশ হরেণ মল্লিক নামে এক ব্যবসায়ী কিনে নিয়েছেন৷হালেই তার বাড়ি তৈরীর কাজ শুরু হয়েছে অনেকটা মাটি খোড়াও হয়েগেছে৷রাত্রেবেলা চারিদিক অন্ধকারই থাকে৷সকলের বাড়িতে electric connention  প্রায়ই আসেনি৷দেব বাবুর নাতনীরা বিকেলে খেলা ধুলা করে এসে যখন পড়তে বসে তখন ঐ পড়ার টেবিলেই বই এর মধ্যে মাথা গুজে ঘুমিয়ে পরে৷ওদের মা পড়ার টেবিল থেকে তুলে নিয়ে ঘুমের মধ্যেই ভাত,ডাল,তরকারি এক সঙ্গে মেখে খাইয়ে দেয় তারপর বিছানায় শুয়ে দেয় ওরা কোনও কিছুই টের পায়না৷তখন বাচ্চাদের জীবনের বেশীর ভাগ সময়টাই খেলা ধূলায় কাটত৷দৌড়া দৌড়ি ঝাপা ঝাপি করে তারা এতটাই ক্লান্ত হয়ে পরত যে সন্ধ্যে হতে না হতেই ঘুমে তাদের চোখ টেনে ধরত৷রাত ৮ র মধ্যে সকলেই গভীর নিদ্রায়৷ঘুমের ঘোরে যাতে বিছানা ভিজিয়ে না দেয় সেইজন্য রমা নিত্যই রাত ১০টা নাগাদ তাদের বাথ রুমে নিয়ে যেতেন৷তারাও ঘুমের মধ্যে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে আবার নির্বিঘ্নে বিছানায় শুয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে পরত৷নবীন আর তারকের বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত সারে নয়টা দশটা হয়৷রমা শশুর শাশুড়ি কে ৯টার মধ্যে রাতের খাবার দিয়ে দেয় ৷তারপর স্বামী আর দেওর এলে তাদের গরম গরম রুটি সেঁকে দেয় তাই রাত অবধি ঊননে আঁচ ধরিয়ে রাখতে হয় ৷সব কাজ মিটিয়ে শুতে শুতে রাত ১১টা হয়৷এভাবেই এদের দিন যাপন হয়৷একদিন রাত ১০টা নাগাদ হঠাৎই আল্লাহ হো আকবর চিৎকার শোনা যায়৷হঠাৎ এমন চাৎকার যেন একদল মুসলমান বলপূর্বক এই এলাকায় অনুপ্রবেশ করে ফেলেছে৷ রাতের বেলায় সকলের শীথিল হয়ে যাওয়া স্নায়ু হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে যায়৷ভয়ে আতঙ্কে কে কি করবে দিশা পায়না৷ নবীন তাড়া হুড়ো করে দুই মেয়ে তুলী আর গৌরীর হাত ধরে টেনে তোলে৷বলে"তাড়াতাড়ি  ওঠ সামনে বিশাল বিপদ৷"এই বলে তাদের হাত ধরে টানতে টানতে ঘর থেকে বার করে আনে৷ এমন অবস্থায় যে করেই হোক ডঃ ব্যাণার্জীর বাড়ি পৌছতেই হবে৷কিন্তু রোজকার নিয়ম মাফিক তুলী ও গৌরী মনে করে নিশ্চয় তাদের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছে৷তাই তারা দুজনেই উঠানে বসে পরে৷নবীন হতবম্ভ হয়ে বলে"সামনে এমন বিপদ আর তোরা প্রস্রাব করছিস৷এদের এই প্রকৃতির ডাক শেষ হতে হতে মুসলমানরা আমায় না শেষ করে দেয়৷"তারপর নিদ্রাচ্ছন্ন দুই মেয়ের হাত ধরে টানতে টানতে দৌড় দেয় ডাক্তার বাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে৷তারক আগেই তার মা ও বৌদি কে নিয়ে রওনা হয়েছে আর নবীনের দায়িত্বে পরেছে তার নিদ্রাচ্ছন্ন দুই কন্যা৷চারিদিকে হই হই সকলেই যে যার বাড়ি থেকে যে যেমন অবস্থায় ছিল ডঃ ব্যাণার্জীর বাড়ির পথে দৌড়াচ্ছে৷নবীন ভয়ে আতঙ্কে দৌড়াতে দৌড়াতে হরেণ মল্লিকের জমির গর্তে পরে কুপকাত৷নিদ্রাচ্ছন্ন তুলী আর গৌরীর এতক্ষণে ঘুমের ঘোর কাটে একে অপরের দিকে চেয়ে বলে"আমরা কোথায়"৷নবীন ব্যাথায় চেঁচিয়ে ওঠে গর্তে পড়ে তার বাঁ পা মোচকে গেছে৷বিপদ সামনে এলে শরীরে এক আশ্চর্য শক্তি চলে আসে তাই কোনও রকমে ঐ গর্ত থেকে উঠে খোড়াতে খোড়াতে দুই মেয়ের হাত ধরে ডাক্তার বাবুর বাড়ি পৌছায়৷ডঃব্যাণার্জীর বাড়ি তখন একটা ছোট খাটো রিফিউজি ক্যাম্প৷ছোট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ সকলের নানা বক্তব্য আলোচনা৷নবীনকে দেখে মনে হচ্ছে উনি তো বেশ কয়েক জনের সঙ্গে হাতাহাতি করে এত দূর এসেছেন৷চুল উস্কো খুস্কো পাঞ্জাবীতে মাটির দাগ বাঁ পা ফুলে উঠেছে৷রমা দেবী ছুটে এসে বললেন"কি হল একি অবস্থা তোমার"৷ডঃব্যাণার্জীর যুবতি কন্যা শকুন্তলা খুবই তৎপর সে দ্রুত মলম নিয়ে এসে নবীনের পায়ে লাগিয়ে দেয়৷এরই মধ্যে সব মেয়েদের চিৎকার শুনে শকুন্তলা ছুটে যায়৷হল ঘরে গিয়ে দেখে হল ঘরের এক কোনায় সব মেয়েরা জড়ো হয়েছে কেউ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে কেউ চোখ বন্ধ করে কেউ হেসে গড়াচ্ছে৷তার ঠিক উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে বছর ১৩কি ১৪র এক কিশোর৷সেও ঐ পাড়ারই বাসিন্দা নাম তার ডিব্বা৷কিন্তু ডিব্বাকে দেখে এই চিৎকারের কারণ ডিব্বা সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় জড় সড় হয়ে দাঁড়িয়ে৷ঐ বিছানা ভেজাবার ভয়ে ডিব্বার মা তাকে জামা কাপড় ছাড়া ঘুমানোর অভ্যেস করিয়েছেন৷তাই এই দুরবস্থা৷মুসলমানদের আতঙ্কে সেও গায়ে কিছু না দিয়ে,যেই অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় চলে আসে৷শকুন্তলা চোখের পলকে একটা বিছানার চাদর এনে ডিব্বার দিকে ছুড়ে ডিব্বার লজ্জা নিবারণ করে৷এই সব হৈ হট্টোগোলের মধ্যে রমা ননীর খোজ করে"ননী ননী কোথায় ওকে তো আনা হয়নি ও তো বাবার কাছে রয়ে গেছে"৷এই বলে রমা কান্নায় ভেঙে পড়ে৷কি করা যায় নবীনের পায়ের যা অবস্থা সে তো কোনও ভাবেই এতটা পথ যেতে পরবে না৷তখন দুর্দান্ত সাহসী তারক বলে"আমি যাব,আমি গিয়ে ননীকে নিয়ে আসব"৷তুলী গৌরী অঝোর নয়ণে কাকার কাছে বিনীত অনুরোধ করে"কাকা ননীকে যখন আনবে তখন দাদুকেও নিয়ে এস"৷সবাই মিলে তুলী আর গৌরীকে বোঝায় দাদুর বরস হয়েছে উনি এতটা পথ পায়ে হেঁটে কোনও মতেই আসতে পারবেন না৷তারক বাড়ি ফিরে যায়৷চারিদিক নিঃঝুম চুপ চাপ৷শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকার আওয়াজ৷রাস্তা ঘাট ঘুটঘুটে অন্ধকার৷বাড়ি পৌছে তারক সিঁড়ির তলায় জড়ো করে রাখা নানা কাজের অকাজের জিনিসের মধ্যে থেকে আত্মরক্ষার জন্য একটা সাবল বেছে নেয়৷তারপর নিজের ঘরে ঢুকে আলমারি খুলে বিয়ের স্যুট আর নতুন কেনা রেডিওটা একটা ব্যাগে পুরে নেয়৷এই চরম আতঙ্কের মুহুর্তেও সে বিয়েতে পাওয়া স্যুট আর সখের রেডিওটার মোহ ছাড়তে পারেনা৷তারপর দেব বাবুর ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত দেববাবুর পাশে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত ননীকে কোলে তুলে নেয়৷আজ তারক প্রায় দশভুজা অস্ত্র সজ্জিত এক হাতে স্যুট ও রেডিওর ব্যাগ আর কোলে ননী৷এমন ব্যতিক্রমী প্রস্তুতি তো সয়ং মা দূর্গাও নেননি৷জিনিসের মায়া যেমন ত্যাগ করতে পারেনি তেমন ভাইঝিকেও ভুলে যায়নি৷এদিকে ডাক্তার বাবুর বিশাল ছাদে সারি সারি থান ইঁট ও কাঁচের বোতল সাজানো রয়েছে যাতে দূর থেকে আক্রমণকারীদের দেখলে ঐ গুলো ছুড়ে  মেরে আক্রমণকারীদের আটকানো যায়৷এরই মধ্যে অস্ত্র সুস্বজ্জিত তারক ননীকে কোলে নিয়ে ডাক্তার বাবুর বাড়ি এসে পৌছায়৷ঐ রাতটা এঅভাবেই কেটে গেল কোনও মুসলমান আক্রমণকারীর ছায়াও দেখা গেল না৷পরের দিন সকালে জানা গেল দু তিনটে মাইক লাগিয়ে বেশ কয়েক জন মিলে আল্লাহ হো আকবর চেঁচিয়ে ছিল যাতে সব হিন্দুরা ভয় পেয়ে যায়৷তুলী গৌরী খুব ভয় পেয়েছিল তাদের প্রিয় দাদুকে মুসলমানরা হয়ত মেরে ফেলবে৷দাদুকে পেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে গৌরী বলে"জান দাদু কাল মুসলমানরা এসেছিল আমরা সবাই ডাক্তার বাবুর বাড়ি চলে গিয়েছিলাম তুমি তো কিছুই জাননা তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে৷তুলি আর আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম,দাদু আমরা তোমার জন্য খুব কেঁদেছি৷"দেব বাবু নাতনীদের বললেন" না গো দিদি আমি তো ঘুমের ভান করে চুপ করে শুয়ে ছিলাম আমি তো বুড়ো হয়েছি আজই মরি কি কাল তাই মুসলমানরা মেরে ফেললেই কি যায় আসে৷"এই হট্টগোলে সবাই যে যার চিন্তা করেছে নিজের প্রাণের,সম্পত্তির,প্রিয় জনের কিন্তু বৃদ্ধ দেব বাবুর কথা হয়ত সকলের মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷দেব বাবুর তাতে কোনও নালিশ নেই৷এটাই সত্য ঐ পরিস্থিতিতে সত্যিই দেব বাবু কে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না৷এটাই বাস্তব ঠিক যেমন মৃত্যুটা একটা বাস্তব সত্য৷কিন্তু দেব বাবুর মতো খোলা মনে সবকিছু সরলতার সঙ্গে গ্রহণ করার ক্ষমতা কজনের আছে৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন