Translate

রবিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৮

কর্ম ফল *


        #কর্ম_ফল  
  #রচনায় #প্রিয়ম্বদাপ্রিয়া
       দুপুরের সময় লোকাল ট্রেনে সামান্য ভিড়। তারমধ্যে এক ফেরিয়ালা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ডালি সাজিয়ে গ্রেব হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে যাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে। এক এক জনের মুখের আব ভাবে নিজের বিক্রির সম্ভবনা আন্দাজ করতে লাগল। এক মহিলা সেফটি পিন কিনলেন এক জন প্লাস্টিকের কাভার হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। গ্যাঞ্জির দড়ি, টর্চ, চাবির রিং, ক্লিপ, টিপের পাতা ,ইমিটিশনের হার দুল আরও হরেক রকম জিনিস রয়েছে তার কাছে।কোনও কোনও যাত্রী হাত দিয়ে সরিয়ে নিজের প্রোয়জনের বস্তুর সন্ধান করছে। কেউ আবার চলন্ত ট্রেনের দোলায়  ঝিমচ্ছে। খোলা দরজার মুখের সামনে দুজন কামিন বসে আনমনে বাইরের চলন্ত দৃশ্যে মহিত। স্টেশনে ট্রেন থামতে আবার যাত্রীর ওঠানামার ভিড়ের মাঝে এক মহিলা চেঁচিয়ে উঠল ..."আমার চেন ...আমার চেন..."ট্রেনটা সবে ছেড়েছে প্লাটফর্মের বিপরীত দিকের ট্রেনের দরজা দিয়ে লাফ মেরে বড় বড় পা ফেলে লাইন টপকে ছুটল পটা।হাতের চেনটা শূন্যে ছুড়ে আবার হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে জয়ের হাসি হাসল। 




        আস্তানায় ফিরে সবার সামনে আজকের পরিশ্রমের উপার্জন মেলে ধরল পটা। নন্টা বলে..."বস কি মাল পেয়েচ তোমার তো গুরু আজ বরাত ভালো। "উসমান ওদের দলের লিডার চেনটা হাতে নিয়ে বলল ..."বেবকুফ বনে গেছিস। শালা মাল চিনিস না রূপার উপর সোনার জল চড়ানো আছে। "পটা ভ্রূ কুঁচকে মাথা চুলকে বলে..."তাতে কি আছে আজকাল ট্রেনে কেউ সোনা পরে না।রূপা বেঁচলেও দাম পাব। "উসমান চেনটা ছুড়ে বলল ..."বেঁচে ভাগের মাল দিয়ে যাবি। "পটা এক লাফে উসমানের কাছে গিয়ে ও'র ঘাড় পিঠ টিপতে টিপতে বলল ..."উস্তাদ মেয়েটার শরীর ভালো না যদি কটা দিন...। "
..."ঠিকাছে লেকিন হর বখক্ত উ সব শুনব না পুরো টাকা লিব। "বললো উসমান।
      




     রাস্তার ধারে জীর্ণ ঝুপড়ি পটা ঢুকতেই দেখল খাটের উপর মেয়েটা শুয়ে। বিন্দি ভাত নামাচ্ছে। পটা খাটে বসে মেয়ের মাথায় হাত রাখে দেখে গা গরম বিন্দকে বলে ..."কি রে জ্বর সারে নি। "রোগা ছোটো খাটো চেহারার বিন্দি বালতির জলে হাত ধুয়ে জল ভরা পুরনো একটা বোতল পটার সামনে ধরল।বললো..."ওষুধ লাগবে। এমনি সারবে না। " সারা রাত ভালো করে ঘুম হল না পটার। কাল অফিস টাইমে ভারি পকেট খালি করতে হবে।বড় হাত না মারলে চলবে না। কদিন ধরেই বাজার মন্দা যাচ্ছে।





      সকালে  অফিস টাইমে পটা উঠে পড়ল ভিড় ট্রেনে।ভিড়ের মাঝে একজনের উঁচু পকেট তাক করে হাতটা সন্তপর্নে   ঢুকিয়ে পার্স বের করে ঢুকিয়ে নিল নিজের শার্টের ভিতর। স্টেশনে নেমে তড়িঘড়ি ব্যাগ খুলে দেখে কাগজ বেশী টাকা কম। মাথায় আগুন জ্বলে গেল। শালার কপাল! ভাবল মোটা হাত মারবে তা না। শালা ট্রেনে ওঠে ভিখারি সাহেব। গজ গজ করতে করতে ওষুধের দোকানে এসে ওষুধ নিল,জ্বরের টেবলেট দিয়ে দিন তো! দোকানী দুটো ট্যাবলেট রূপালী ফয়েল থেকে কাঁচি দিয়ে কেটে রাখল পটার সামনে।ওষুধ নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখে বিন্দি নেই।মেয়েটা ঘুমচ্ছে ।রান্না করা ঝোল ভাত চাপা দেওয়া।রাগ হল পটার। মেয়েটাকে ফেলে গেল কোথায় বিন্দি। গোটা দুপুর কাটল উশখুশ করে।ঝুপড়ির বাইরে এসে বিড়ি ধরিয়ে টানল ধুঁয়া।পেটে ডাক পড়তে ঢাকা দেওয়া খাবার খেয়ে নিল গোগ্রাসে। খাওয়ালো মেয়েটাকেও।বিকালে বিন্দি ঢুকতেই পটা খেপা কুকুরের মতো তেড়ে এল ..."সকাল থেকে কোথায় ছিলি? মেয়েটার জ্বর আমি ঘর বাইর সব সামলাব!"বিন্দি হাতের বিস্কুটের প্যাকেট খুলে বিস্কুট গুলো ঢেলে রাখল কৌটয়।পটার কথার উত্তর দিল না। পটা আরও খেপে গেল।বিন্দির হাত টেনে ধরল।বললো..."বল কোথায় গিছলি।"
..."তোর টাকায় আমার মেয়ের জ্বর সারবে না আমি লোকের বাড়ি ঘর মোছা বাসন মাজার কাজ ধরেছি। তোকে অনেক বলেছি তুই শুধরাবি না ।চোর সারা জীবন চোর হয়ে থাকবি। "পটা বিচলিত হয়ে খাটে বসে দুলতে লাগল। খাট থেকে নেমে এক লাফে এগিয়ে এল বিন্দির কাছে ..."এই চোর তোকে বিয়ে করেছিল বিন্দি!তোর বাপ তো মাল খেয়ে তোকে বেঁচে দিচ্ছিল। "পুরনো কথা মনে করাতে বিন্দির চোখটা ছল ছল করে উঠল। গলার স্বরটা নরম হল।..."পটা তুই জেলে গেলে আমার অার নিতার কি হবে। "পটা বিন্দির হাত দুটো চেপে ধরল।  ..."একটা লম্বা হাত মারতে দে বিন্দি মাইরি বলছি এ লাইন ছেড়ে দিয়ে ট্রেনে মাল বেঁচব। সত্যি বলছি। "বিন্দি একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে নিজের রান্নার কাজে চলে গেল।
           





পটা ঠিক করে নিয়েছে ওকে কিছু করতেই হবে। এই ভাবে পকেটমারি করে আর চলবে না। বড় হাত মারতেই হবে।আস্তানায় গিয়ে সবাইকে বললো ..."এভাবে ছোট খাটো হাত মেরে লাভ নেই বড় পার্টি ধরে লুঠতে পারলে তবে লাভ।"উসমান রাজি হল না বললো..."অতে অনেক খতরা আছে।"জমল না দেখে মেজাজ খাট্টা হল নন্টার।





      দিনকয়েক পর নন্টা পটার ঝুপড়িতে এল। নন্টাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে ঝুপড়ির বাইরে নিয়ে গেল পটা। দুজনে ঝুপড়ির বাইরে ফন্দি আটল। নন্টা  বলে ..."উসমান বুড়ো হয়ে গেছে যা করার আমাদের করতে হবে। একটা রাম দাঁ বা ভোজালি যোগার করে রাতে ফাঁকা রাস্তায় সুযোগ বুঝে মাল ধরতে পারলে তবে লাভ। "ফস করে একটা বিড়ি ধরাল পটা। ফুসফুসে ভরে নিল তামাকের ধোঁয়া।মাথা ঝাঁকিয়ে বললো ..."ঠিক বলেছিস।"কিছুটা তফাতে বিন্দি দাঁড়িয়েছিল।শুনল ওদের সব কথা।পটা ঝুপড়িতে ফিরতে বিন্দি বলে..."আমি থাকা পরার কাজ পেয়েছি নিতাকে নিয়ে চললাম তোর পাপের টাকায় আর এক দানা ভাত দাঁতে কাটব না। চুরি ছেড়ে খুন করবি। তারপর আমার মেয়ে খুনির মেয়ের পরিচয়ে বড় হবে আমি হতে দেব না। "
..."অত বেশী কথা বলিস না। টাকা ছাড়া কিছু আসে না দুনিয়ায়! "
..."টাকা রোজগার তুই তোর মতন কর আমি আমার মতন করে নেব। "বিন্দিকে অনেক ভাবে আটকাতে চাইল পটা বোঝাল। কিন্তু বিন্দি ওর কোনো যুক্তি শুনল না।মেয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বিন্দিকে আটকাতে না পেরে  রাগে গজ গজ করল।চেঁচাল একাই ..."যা! যাবি তো। যখন অনেক পয়সা করব তখন ঠিক আসবি।ঘুরবি আমার আশে পাশে। দেখব তখন কোথায় যায় তোর তেজ।"
     



  প্ল্যান মাফিক রাতের বেলায় ফাঁকা রাস্তার ধারে পটা আর নন্টা ভোজালী হাতে মুখ গামছায় বেঁধে যাত্রীর অপেক্ষায় রইল।  অন্ধকার চিড়ে স্কুটারের হেড লাইটের আলো এগিয়ে এল ওদের দিকে।এক তরুণ আর বয়স্ক আসছিল ।ওরা হঠাৎ করে রাস্তার মাঝে রে রে করে ছুটে এসে স্কুটার দাঁড় করাল।যাত্রীরা আতঙ্কে কি করবে না করবে বোঝার আগেই ভেজালি দেখল নন্টা। পটা বললো ..."ঘড়ি, আংটি মানিব্যাগ মোবাইল সব দে! "ভীত আতঙ্কিত তরুণ আর বয়স্ক দিয়ে দিল ওদের চাহিদার সব জিনিস পত্র।জিনিস পত্র লুটে দুজনে চম্পট দিল অন্ধকারে। 




      ভালো টাকার লাভ। কিন্তু চুরির জিনিস এত সহজে বেঁচা যায় না। দামও সেরকম মেলে না।তবে পকেটমারির থেকে লাভ অনেক বেশী। নন্টা বলে..."পটা শালা ট্রেনে ছিনতাই এর থেকে এটা তো বেশী ভালো রে চল আজও যাব। "পটা এই পেশায় নবাগত হলেও বুদ্ধি রাখে বলে ..."রোজ রোজ লুঠ করলে ধরা পড়ে যাব অন্য রাস্তায় লুঠতে হবে তাও ক'দিন পরে। "পরিকল্পনা মত ক'দিন পর ওরা আবার ফাঁদ পাতল এবার রাস্তার উপর পেরেক বিছিয়ে রেখেছে। একটা চার চাকার গাড়ি আসতে দেখে নন্টা বলে..."পটা আসছে ...মাল আসছে। "পেরেকে টায়ার পাংচার হয়ে খানিক দূরে গিয়ে গাড়ি থামতে পটা হামলা করল। গাড়ির ড্রাইভার একজন মহিলা ।সহজ শিকার।পটা ভোজালি দেখিয়ে বলে..."যা আছে সব দে। "মহিলা কম্পিত কন্ঠে বলে..."সব নিয়ে যাও আমাদের যেতে দাও আমাদের সঙ্গে অসুস্থ বাচ্চা আছে আমাদের তাড়াতাড়ি হাসপাতাল যেতে হবে । "পটা উঁকি মেরে দেখল মহিলার পাশের সিটে একটা বাচ্চা ঘুমচ্ছে। মহিলার সোনার চেন, দুল, মোবাইল পার্স লুঠে ও'রা আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। 
       




       সকালে ঘুম থেকে উঠে অনেক রঙীন স্বপ্ন নিয়ে দু চোখ মেলল পটা। ঝুপড়ির জীর্ণতা মলিন বস্ত্র আবর্জনা সব কিছুর থেকে চিরতরে মুক্তি পাবে পটা। মোটা টাকা পেয়েছে এবার একটা স্টল দেবে একটা ভালো বাড়িতে ভাড়ায় উঠবে বিন্দি আর নিতাকে সেই ঘরে তুলবে। এবার ভদ্রলোক হবে পটা। বিন্দি আর রাগ করতে পারবে না।এবার সুখ ই সুখ।এমন সময় টিনের দরজার কড়াটা কেউ দম দম করে ধাক্কাল। যেন আচমকা অযাচিত কেউ ও'র স্বপ্ন ভঙ্গ করল। বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতেই ও'র মাথার পেছনে চাটি মেরে ওর ঘেটি ধরল পুলিশ।এক ঠেলায় জিপে ওঠাল।  হঠাৎ অপ্রত্যাশিত পুলিশের অভিযানে হতভম্ব হয়ে যায় পটা। একটু আগেই তো ভাগ্য সদয় হয়েছিল তাহলে এমন পরিস্থিতি কেন।এমন তো ভাবেনি কোনো দিন।




     জেলে পুলিশের লাঠির ঘায়ে পটা সব স্বীকার করল।  চুরি ছিনতাই এর দায়ে জেলও হল পটার। জেলে অজস্র কয়েদির মাঝে পটা একা। বিন্দির চোখ দুটো সব সময় ওর পিছু করে যেন বলে..."পটা কেন এমন করলি কেন আমার বারণ শুনলি না। "কচি মেয়েটার মুখ মনে পড়ে মনে পড়ে ওর নরম হাত দুটো দিয়ে ওর চোর বাবার গলা জড়িয়ে ধরত। মেয়েটার চোখে কোনও দিনও প্রশ্ন ছিল না। সন্দেহ ছিল না। ছিল শুধু ভালবাসা। আচমকা  কানে এল ...পটা তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। "ছুটে এল ও।' নিশ্চয়ই বিন্দি।ও ছাড়া কে আসবে ওর সঙ্গে দেখা করতে। ঠিক তাই।থমথমে মুখে ও'র দিকে তাকিয়ে বিন্দি।বিন্দির  মুখটা দেখে বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল পটার।কেমন শুকিয়ে গেছে বউটা।হাঁ করে পটা তাকিয়ে রইল বিন্দির দিকে।বিন্দি গলার স্বর ক্ষীণ।ও বললো..."তোকে কে পুলিশে ধরাল জানিস? "পটার চোখের ভাব বদলালো। কি বলছে বিন্দি। একটা শ্বাস ছেড়ে বিন্দি বললো..."সেদিন যে ম্যাডামের গাড়ি  লুঠলি তার পেছনের সিটে আমি বসে ছিলাম ।ঐ ম্যাডামের বাড়িতেই থাকা খাওয়ায় ছিলাম আমি। ওনার মেয়েকে দেখা শোনা করতাম। তোর গলা শুনেই চিনেছিলাম তুই লুঠতে এসেছিস। আমার মেয়েটা সিঁড়ি থেকে পড়ে মাথায় চোট লেগেছিল ওকেই হাসপাতাল নিয়ে যাচ্ছিলাম। তোর জন্য সময়ে হাসপাতাল পৌছতে না পেরে মেয়েটার কত কষ্ট পেল। কত দিন  জ্ঞান ছিল না । আজ শশ্মান থেকে ফিরছি। তোর সব পাপ আমার কচি মেয়েটা ও'র ছোট্ট শরীরে নিয়ে নিল। কত কষ্ট পেয়ে কচি প্রাণটা চলে গেল পটা। সব তোর জন্য তোর লোভের জন্য। পরিশ্রম না করে লুঠের মালে দিন কাটাবার স্বপ্নের জন্য।" বলতে বলতে বিন্দির গলা ধরে আসছিল।আচল দিয়ে চোখের জল মুছল বিন্দি।ভেজা চোখে বুকে একরাশ বেদনা নিয়ে একাকি জীবন যুদ্ধে পারি দিল বিন্দি। পটা চেয়ে রইল শূন্য দৃষ্টিতে। কোনো ভাব বেদনা কিছুই যেন অনুভূত হচ্ছে না। দম বন্ধ লাগছে বার বার মেয়ের মুখটা ভেসে আসছে চোখের সামনে।কি করল ও। কার ক্ষতি করে নিজে লাভবান হতে চাইল! ওর ক্ষতিপূরণ হবে কি কোনো দিন। ©Pryamboda priya
28

অনুভূতির আসর  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন