Translate

শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮

একলা ভোগ করি *

   #একলা_ভোগ_করি(রিপোস্ট)
#রচনায়#রিমা_বিশ্বাস(প্রিয়ম্বদাপ্রিয়া)
     গরমের ছুটিতে বিনয় স্বপরিবারে বাড়ি এসেছে। কর্মসূত্রে সে গুজরাটে থাকে ছুটি ছাটা পেলে বারাসাতের বাড়িতে আসে। ভালো চাকরি আর যোগ্যতার বলে বিনয় ভালোই টাকা পয়সা কামিয়েছে। সেই আন্দাজে ছোট ভাই পলাশের অবস্থা মন্দের ভালো। বিনয়ের পাঁচ বছরের হোঁতকা ছেলে গোগলকে বিনয়ের স্ত্রী রীতা গোটা একটা বার্গার কিনে এনে মুখে ঠুসছে । পলাশের তিন বছরের মেয়ে মিনি অবোঝ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। গোগল বার্গার মুখের মধ্যে  নাড়া চাড়া করছে মিনি তা দেখে অজান্তেই ঢোক গিলছে। ঠাকুমার এই দেখে বড্ড কষ্ট হল বলল..."বৌমা মিনিটাকে একটু ভেঙে দিতে পারতে। "রীতা বিরক্ত হয়ে বলল..."ওরে বাবা, আমার গোগল গোটা খেতে অভ্যস্ত ঐ ভাঙলে ছিড়লে হুল স্থুল কাণ্ড করবে। "





        দিন কাল গড়িয়ে অনেক গুলো গরমের ছুটি পেরল। বিনয় সময়ের সঙ্গে ধনে মানে আরও সম্পত্তি করল। আহমেদাবাদে বিরাট বড় বাংলো, কলকাতায় 3বিএইচকে ফ্ল্যাট বিশাল ব্যাপার। বিনয়ের হোঁতকা ছেলে গোগলও বাবার অর্থ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে করে গেছে চর্বি বৃদ্ধি । বিনয়ের বড় গর্ব হয় নিজের উপর। গত বছর বি.এম.ডবলু কিনেছে। কোথা থেকে কোথায় উঠে গেছে। ওর মধ্যে বিশেষত্ব নিশ্চয়ই আছে। নিজের মনে নিজেই হাসে। এই তো সেদিন মন্দিরে দশ হাজার টাকা দান করল ওর বাপ ঠাকুরদা কোনও দিন ভেবেছে। তারা একশ এক টাকা চড়ালেই ভাবত ভগবানকে অনেক মোটা অঙ্কের সুপারিশ করা হয়েগেছে সেখানে বিনয় দশ হাজার করে দান দেয়। ভাবা যায়! 





        বিনয় ওর শৌখিন চেয়ারে বসে পঞ্চাশ ইঞ্চি এল ই ডি টিভিতে মনোরঞ্জনে মগ্ন। রীতা পাশে বসে বলল..."কি গো ইউরোপ ট্যুরটার কি হল। "বিনয় টিভি স্ক্রীনে চোখ স্থির রেখে অ্যকশন সীনটা উপভোগ করতে করতে বলল..."থাইল্যান্ড, মলদ্বীপ,দুবাই যখন হয়েছে এটাও হবে।"
..."আমার শপিং করার আছে মিসেস রয়ের প্লাটিনাম ব্রেসলেট টা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। "প্লাটিনাম শুনে বিনয়ের বেশ লাগল। সত্যি হাইপ্রোফাইল সোসাইটিতে পুরো সেট হয়েগেছে ও। ঐ সব সোসাইটিতে উঠতে বসতে গেলে তার রকম সকমই আলাদা।তা রপ্ত করতে পেরেছে মিঞা বিবি। যেমন আয় তেমন ব্যায়। বৌ ডিজাইনার শাড়ি পরে ম্যাচিং জুতো পার্স এক একটা কি দাম শুনলে মনে হয় সত্যি উন্নতি করেছ ও। ওর আত্মীয়স্বজন ভাবতে পারবে এত দাম দিয়ে জিনিস কেনার কথা।বউএর  আবার এখন সোনা ছেড়ে প্লাটিনামে ঝোঁক হয়েছে।এই সব বিনয়ই তো মেটায়।বাড়িতে দামি বিলেতি মদের বন্দোবস্ত করেছে।তারপর মেডিক্লেইম, ইন্সিউরেন্সের টাকাও ভরতে হয়। আয়  ব্যয় দুই সমান। সব কিছু ভেবে নিয়ে একটা শ্বাস ছেড়ে ভাবল যাই হোক ইউরোপের ট্রীপটা মাস্ট। ওটা কোনও ভাবে ক্যানসেল করা যাবে না। তবে যে স্ট্যাটাসের দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়বে।মি.দত্ত মন.কানুনগো কথায় কথায় খালি ইউরোপ দেখায় এবার ইউরোপ যাবে বিনয়। 
         





    বিনয় কিছুদিনের  ছুটিতে কলকাতার ফ্ল্যাটে এসে উঠল।ছুটি ছাটা পেলে কলকাতা ঘুরে যায়।বৌএর সঙ্গে বসে ল্যাপটপে সুইজারল্যান্ডের বৃত্তান্ত দেখছে।বৌকে বলল ..."শুনছ গত বার মি.দত্ত গিয়েছিল। ভাবেনি আমিও যাব। "রীতা মুখ বেঁকিয়ে বলল ..."না ভাবার কি আছে আমরা যেতে পারিনা না নাকি। "
..."সব জেলাস বুঝলে রাট্ রেসের দৌড়ে কেউ যদি এগিয়ে যায় অপর জন নিজেকে খাটো ভাবতে শুরু করে ।তার পর প্রতিযোগীর অবনতি কামনা করে। "বলে একটা তীক্ষ্ণ হসি হেসে বলল..."আমি ভীষণ এক্সাইটেড রীতা ,ফার্স্ট টাইম ইউরোপ। " ওদের কথার মাঝে  কাজের লোকটি এসে বলল..."দাদা একজন দেখা করতে এসেছে বলছে আপনার আত্মীয়। "বিনয় একটু চিন্তা করে বলল..."আমার আত্মীয় ..."তারপর বললো ঠিকাছে ভিতরে পাঠাও। "একটা রঙ ওঠা ছাপার শাড়ি পরা বয়স্ক মহিলা ওদের ড্রয়িং রুমে ঢুকল। শাড়িটা নোংরা নয় বহুবার ধোয়ার জন্য ওর আসল রঙটা মিলিয়ে গেছে। মাথায় সাদা কালো চুল। মোটা পাওয়রের চশমা। বয়স পয়শট্টি বা তার বেশী হবে। উনি  ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলেন। তাকে দেখে বিনয়ের চিনতে দেরি হল না।এতো কাকিমা।ওরা ডাকত সোনা কাকিমা তবে অভাবি কাকিমা ডাকাটা বোধ হয় বেশী যুক্তিযুক্ত হত। বিনয় বললো..."আরে সোনা কাকিমা যে। "ভদ্রমহিলা হেসে হেসে বললেন ..."হ্যাঁরে বিনু। তুই কলকাতায় এসেছিস শুনে দেখা করতে এলাম। "শুধু যে দেখা করতে আসেনি তা আন্দাজ করেছে বিনয়। এমন বেশভূষার মানুষ তার কাছে বহুবার এসেছে। দান দক্ষিণা মন্দিরে করতেই ভালো লাগে সুযোগ সন্ধানী মানুষ দেখলে মাথা গরম হয়ে যায় ওর। বিনয় বলল..."কি করে জানলে আমি কলকতায় আছি। আমার ঠিকানা কে দিল? "
..."তোর ভাই পলাশ দিল রে বিনু।"কেমন আছ জিজ্ঞাস করতেও ভয় লাগে।এক্ষুনি হয়ত অভাবের গান শুরু করবে। তাই বিনয় একটু ঘুরিয়ে জিজ্ঞাস করল ..."এখন সোনাকাকা রোজ মিলে যাচ্ছে তো? "সোনাকাকিমা ফিকে শাড়ির   আচলটা সামনে টেনে  কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল..."বিনু বড় অসহায় হয়ে তোর কাছে এসেছি। "বিনয় মনে মনে বলল জানতাম এ আর নতুন কি।আমার টাকা আছে মানে সব ভিখারির দায়িত্ব আমার। সোনাকাকিমা বলে গেলেন ..."ছেলেটা অসুস্থ। হাঁপানির চিকিৎসা করতে পারি না।ও বাইরে কাজ করবে কি করে! তোর সোনাকাকার অনেক বয়স হয়ে গেছে।যে কারখানায় কাজ করত সেটাও বন্ধ। তুই কিছু সাহায্য করলে বেঁচে যেতাম।"রীতা ভেবেছিল চা করতে বলবে কিন্তু অমন লোককে চা পানি খাইয়ে কি কাজ।এ মরণ যা ধুকছে কোনও কাজেই আসবে না।ও আবার স্মার্ট ফোনে মন দিল। বিনয় বলল..."আমি এমন আর কি দিতে পারব ।দু তিন হাজারে তো তোমার কিছু দিন চলবে তারপর ...তারপর কি করবে। "
..."দু তিন হাজারের জন্য তো আমি আসিনি বিনু। "বলে সোনাকাকিমা চাইল ওর দিকে।বিনয় সোফা ছেড়ে  উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল..."ওরে বাবা এর বেশী আমি দিতে পারব না সোনাকাকিমা। "একবার রীতার দিকে চেয়ে বিরক্ত হয়ে বলল ..."রীতা তোমার কাছে ক্যাশ আছে। আমার কাছে নেই। "রীতা মোবাইল থেকে চোখ তুলে বলল..."যা বাবা আমি কোথায় পাব। "বিনয় আর রীতার চোখ চাওয়া চাউয়ি দেখে  সোনাকাকিমার বুঝতে কিছু অসুবিধা হল না।যে এরা ওকে মুখে বলতে পারছে না তবে তাড়াতে পারলে বাঁচে।উনি আস্তে করে উঠে পড়লেন।হাঁটু ব্যাথা তাই দু কদম একটু খুঁড়িয়ে এগলেন। তারপর বললেন..."তোর ছোট ভাই পলাশের রোজগার ভালো না। অনেক কষ্টেই ও আমাদের খরচ জোগায়। আমি ভাবলাম তোর অনেক আছে তাই পলাশের উপর বোঝা হই কেন কিন্তু বিনু তুই এত গরিব আমি জানতাম না রে। "বিনয় গরিবের ট্যাগ নিজের ঘাড়ে বসতে দেখে  চিড়বিড় করে উঠল। বিদ্রূপ করে বলল..."বাবা তেজ কমেনি তো। বুড়ো বয়সে খেতে পাও না... হাত পাততে লজ্জা করে না... আবার কথা শোনাচ্ছ। তুমি এখন এসো তো। আমার অনেক কাজ ।"সোনা কাকিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।বললো ..."থাকব বলে আসিনি। তবে বুড়ো মানুষের একটা কথা শিক্ষা হিসাবে নিস। ক্ষমতার সঙ্গে দায়িত্বও বেড়ে যায়।ঈশ্বর তোকে বেছেছেন ধনী করার জন্য তার জন্য গর্ব করিস না কর্ম কর। ভাগ করে খেতে শেখ।"সোনাকাকিমা কথা গুলো বলে ধীর পায়ে চলে গেল। বিনয় চিৎকার করতে লাগল ..."ভিখারী খেতে পায় না আমায় শিক্ষা দিতে আসে। "রীতা বলল ..."শান্ত হওতো মুড ঠিক কর একটু আগে নিজেই তো বললে সবাই জেলাস আমাদের উন্নতিতে।এখন মাথা ঠাণ্ডা করে ইউরোপের ট্যুরটা প্ল্যান কর দেখি।"
       





           ইউরোপের ট্যুর পুরো ঠিক ঠাক। হোটেল ফ্লাইট সব বুক হয়ে গেছে। সকাল বেলায় বেরবে ওরা।  বিনয় রেডি হয়ে ড্রয়িং রুমে লাগেজ গুলো টেনে টুনে বের করছে সেই সময়  হঠাৎ রীতার চিৎকার শুনে বাথরুমে ছুটে যায়। দেখে বাথরুমের ফ্লোরে পড়ে রীতা কাতরাচ্ছে।মরে গেলাম গো মগো বলে চেঁচাচ্ছে। এ দেখে ঘাম ছুটে যায় বিনয়ের।তাড়িঘড়ি  ফোন করে ডাক্তারকে। অ্যম্বুলেন্সে করে সোজা পৌঁছে যায়  নার্সিংহোম।





        নার্সিংহোমের বেডে রীতা শুয়ে। বিনয় পাশে বসে ফোনে বলছে ..."মি.দত্ত আমাদের ইউরোপের ট্যুরটা ক্যনসেল হয়ে গেল।মিসেসের হিপ জয়েন্ট ফ্রাকচার। "তারপর ঠোঁট বেঁকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রীতার মাথায় হাত রেখে বলল..."ভাগ্যিস মেডিক্লেম করা ছিল না হলে কত টাকার ধাক্কা লাগত বল দেখি। "রীতা মুখ বিকৃতি করে কাঁদো কাঁদে গলায় বলে...."তুমি কি মানুষ? টাকা টাকা করছ। আমি যে এত কষ্ট পাচ্ছি তাতে তোমার কিছু আসে যায় না? "ব্যথায় রীতার চোখ মুখ কালো হয়ে গেছে বিরক্তর সঙ্গে ও চোখ বুজে রইল। বিনয় মনে মনে বলল কপালেই সুখ নেই এতদিন প্ল্যান করে সব মাটি হয়ে গেল।ইউরোপের ট্যুরটা ক্যনসেল হল।কত টাকা গোচ্ছা যাবে।দুস! কি যে হয়!হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল সোনাকাকিমার মুখটা। কি যেন বলছিল, ভাগ করে খেতে শেখ। তবে কি কেউ না কেউ হিসেব কষে।না না ও সব ফালতু চিন্তা করছে বিনয়। রীতা অসাবধানতার জন্যই ক্যনসেল হল ট্যুরটা। টাকা আছে তাই গেছে। এত অল্পতে বিনয় ঐ সব কথায় ভয় পাওয়ার লোক নয়। বিনয় মোবাইল খুললো। মেসেজে মেসেজে ভরতি। রাগ হল বিনয়ের খালি মনে হচ্ছে সবাই জেলাস। সবাই খুশি ওরা যেতে পারেনি বলে। রাগে শরীরটা কিশকিশ করছে মনে হল ফোনটাই ছুড়ে ফেলবে। পারল না বসে রইল হসপিটালের চেয়ারে। বসে রইল চুপচাপ। 
Pramboda priya 

অনুভূতির আসর-ফেসবুক পেজ 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন